রেজাউল করিম খোকন

  ১৮ মে, ২০২১

কৃষককে পেতে হবে কৃষিবিপ্লবের সুফল

গত দেড়-দুই দশকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাকসবজি, ফলমূলসহ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে দারুণ বিপ্লব ঘটেছে। বিভিন্ন জেলায় কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। কৃষকের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি। কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও মৌসুম ছাড়া সহজলভ্য হয় না বাজারে শাকসবজি, ফলফলাদি। এক মৌসুমের সবজি ও ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরেক মৌসুম পর্যন্ত। উৎপাদন সূচক ঊর্ধ্বগামী হলেও দামের বেলায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা যায়। মৌসুমের শুরুতে যে সবজি ১০০ কিংবা ১৫০ টাকায় বিক্রি হয় তা আবার নেমে যায় ১০-২০ টাকায়। দাম না পাওয়ায় খেতের ফসল খেতেই পচতে থাকে। কৃষকরা অনেক সময় রাগে-ক্ষোভে তাদের উৎপাদিত ফসল শাকসবজি, ফলমূল ফেলে দেন। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই। উৎপাদিত কৃষিপণ্য, শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে যথেষ্ট পরিমাণ হিমাগার, সংরক্ষণাগার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন আমাদের কৃষক। এ নিয়ে আশা-নিরাশার দোলা শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রেও চলছে বিপর্যস্ত অবস্থা। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশীয় সবজি ও ফলফলাদির বেশ ভালো চাহিদা থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সরকারের নজরদারির অভাবে মার খাচ্ছে রপ্তানি খাতও। উৎপাদন সূচকের সঙ্গে বাজার বণ্টন, দামের ভারসাম্য ও রপ্তানি নীতিমালা বজায় রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক মানের আরো অধিকসংখ্যক হিমাগার ও কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণের দাবি কৃষক, ভোক্তা ও রপ্তানিকারকদের। এ দাবি অনেক দিনের। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের বাণিজ্যিকভাবে যে হারে ফলের উৎপাদন বাড়ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয়ের একটা বড় অংশ আসবে ফলের বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে।

সাধারণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে পার্বত্য জেলাগুলোতে আজকাল প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদন হচ্ছে। সেখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার না থাকায় বাধ্য হয়ে উৎপাদনকারীদের অবিশ্বাস্য কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে সাধারণভাবে থাকার কারণে সবজি ও ফলমূল পচে যায়। ফলে সেগুলোর মান অনেক নষ্ট হয়। তখন লোকসান গুনতে হয় সংশ্লিষ্ট কৃষক এবং বাজারজাতকরণে নিয়োজিত ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের। তখন তাদের সবাইকে লোকসান গোনা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এভাবেই অনেক কৃষক, উৎপাদনকারী চাষি ও ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে কৃষিপণ্য উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক থেকে শুরু করে জমিতে পরিচর্যা, পানি দেওয়া ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরিও বেড়ে গেছে। ফসল উৎপাদনের পর যদি তার উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া যায় স্বাভাবিকভাবে কৃষক বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়ে যান। অনেক সময় উৎপাদিত ফসল বাজারে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন কৃষক। খরচ পোষাতে না পেরে কৃষকের খেতের ফসল খেতেই নষ্ট হয়ে যায়। বিক্রি না করে রাস্তায় কিংবা নদীতে ফেলে দেন তারা। এ ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন কৃষিপ্রধান এলাকায় যদি সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত এবং যথেষ্টসংখ্যক হিমাগার কিংবা আধুনিক সংরক্ষণাগার থাকত; তাহলে কৃষক অনেক বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতেন।

যদিও সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রণোদনা ও প্রদর্শনী খামারের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নে আলাদাভাবে কাজ করছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষক বাজার, এর বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তবে এটা সারা দেশে সমানভাবে চালু হয়নি এখনো। মাঠপর্যায়ের কৃষকদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে সবজি-ফলমূলের ভালো দাম পাওয়া যায় বটে। কিন্তু ভরা মৌসুমে উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়ে গেলে সবজি ও ফলমূলের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ১০-১৫ গুণ কম দামে বিক্রি করতে হয়। তখন হতাশা পেয়ে বসে উৎপাদনকারী কৃষক ও খামারিদের মধ্যে। কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় তারা উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারে নিয়ে যেতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তখন খেতের ফসল খেতেই পচে গলে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এ রকম পরিস্থিতি প্রতি বছরই সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে কৃষকের শ্রম ও তার চেষ্টার ফসলে কৃষির এগিয়ে থাকার কথা সেখানে এক ধরনের দুঃখ-বেদনা-ক্ষোভ আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় পরিবেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে সবজি ও দেশীয় ফলমূল রপ্তানি হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে বেশি রপ্তানি হয়। বিভিন্ন ধরনের কচু থেকে কচুর লতি, কচুরমুখী, ওলকচু, কচুর ফুল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, আলু, মিষ্টিআলু, করলা, কাঁকরোল, পটোল, ঝিঙে, শসা, শিম, লেবু, পেঁপে, জলপাই, কলার মোচা, কাঁচকলা, সাতকরা, শালগম, গাঁজর, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি, ফলমূল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। মূলত বেশির ভাগ সবজি মৌসুমিভিত্তিক রপ্তানি করা হয়। আবার কিছু সবজি সারা বছর রপ্তানি করা হয়। প্রবাসীদের কাছে এ দেশের মৌসুমি ফল ও সবজির কদর বেশি। তবে এখন বিদেশিরাও বাংলাদেশের শাকসবজি, ফলমূল খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। গত বছর করোনা মহামারির প্রকোপে আকাশপথে সবজি রপ্তানি বন্ধ ছিল বলা যায়। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ৭০৪ টন সবজি রপ্তানি হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৬ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ১১৫ টন সবজি রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।

গত প্রায় এক দশকে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে সবজি ছাড়াও ফলমূল উৎপাদনে বড় ধরনের কৃষিবিপ্লব ঘটে গেছে। পেঁপে, আনারস, কাঁঠাল, আম, কমলা, মাল্টা, কলা, কাজুবাদামের মতো দামি ফলমূল ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে এখন। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতের মসলা, ড্রাগন ফল চাষেও অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন এখানকার কৃষকরা। সেখানে উৎপাদিত ফলমূল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি এখনো। এজন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে ফলমূল সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের যথোপযুক্ত অবকাঠামো ও কারখানা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে পাহাড়ে উৎপাদিত নানা জাতের সুস্বাদু ফলমূল, সবজি ইত্যাদি বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সম্ভব হবে আরো অধিক পরিমাণে। দেশে কৃষিবিপ্লব ঘটেছে তাতে কোনো সংশয় কিংবা সন্দেহ নেই। কিন্তু নানা অব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে কৃষিবিপ্লবের সুফল পাচ্ছেন না কৃষক। কৃষিবিপ্লবের সুফল কৃষক যাতে পান তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কৃষিবিপ্লব,কৃষক,রপ্তানি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close