সাধন সরকার
বেকারদের জন্য সুখবর কই
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সাল তরুণদের জীবনে মহাসংকট বয়ে নিয়ে এসেছিল। ২০২১ সালে এসেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেন আরো ভয়াবহ। তথাপি বেকার তরুণ জনগোষ্ঠী একের পর এক সংকটের সম্মুখীন। দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। করোনাকালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি কমে গেছে। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা সময়মতো হচ্ছে না। করোনাকালে হাজার হাজার বেকারের চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে গেছে, অনেকের চাকরির বয়স শেষ হওয়ার পথে রয়েছে। বাড়ছে বেকারত্ব। ফলে স্বাভাবিকভাবে চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়ার দীর্ঘদিনের দাবি করোনাকালে আরো জোরালো হয়েছে। করোনা মহামারি বেকার তরুণ থেকে শুরু করে সবার স্বাভাবিক জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। করোনাকালের পরিবর্তিত বাস্তবতা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজটের সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর অবস্থা তো আরো খারাপ। সময় চলে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে। সরকার থেকে বয়সে সাময়িক ছাড় দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বটে কিন্তু তাতে বেকারের হতাশা কমবে বলে মনে হয় না। বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় বেকার তরুণের আত্মহত্যার খবরও শোনা যায়। যোগ্যতা অনুযায়ী সময়মতো তরুণদের কর্মসংস্থান না হওয়ায় হাজার হাজার বেকার তরুণের স্বপ্ন ও তাদের পরিবারের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
করোনাকালে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। করোনার এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে লাভ লাখো চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স শেষ হওয়া ও সম্ভাব্য সেশনজটের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো সময়ের দাবি। শুধু করোনাকালের এ সময়ে নয়, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিটি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতর-বাহিরও ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর জোর আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো সময় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। যদিও তখন গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। অতঃপর প্রায় ৩০ বছর পার হতে চলল। গড় আয়ুও এখন বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও গড় আয়ু ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এমনকি অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। বিনিয়োগ না বাড়ায় কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সর্বশেষ গবেষণা বলছে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। প্রত্যেক বছর গত বছরের চেয়ে আরো বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর অধিক। বাস্তবতা এটাই যে, এ দেশে বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে কিন্তু চাকরি নেই। করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া জীবনব্যবস্থায় সরকার অনেক সেক্টরে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। এবার সময় এসেছে বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর কথা ভাবার।
উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থান হওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র ‘বেকার ভাতা’ দিয়ে থাকে। করোনাকালে বেকার তরুণদের টুকটাক আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে নিজের পরিবারের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে লোকলজ্জা ভুলে পথে নেমেছেন। বেকার তরুণরা এ রাষ্ট্রের সম্পদ। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাষ্ট্র লাখ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের দেশ গড়ার কাজে গড়ে তোলে। বেকার তরুণরা যদি কর্মসংস্থানসহ নানা কারণে হতাশায় ভোগে সেটা রাজ্যের জন্য লজ্জার। তাই করোনাকালে উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালু করা দরকার। করোনাকালে বেকার ভাতার দাবি আরো জোরালো হয়েছে। বয়সে সাময়িক ছাড় নয়, দরকার চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, করোনাকালে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার। তাই পরিবর্তিত বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালু ও চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো হোক। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বরং সব পর্যায়ের তারুণ্যের মেধা কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। প্রধানমন্ত্রী করোনাকালে তরুণ জনগোষ্ঠী আপনার সুখবরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
[email protected]পিডিএসও/হেলাল