সাহাদাৎ রানা

  ১২ মে, ২০২১

করোনার মধ্যে আরো একটি ঈদ

করোনার মধ্যে আরো একটি ঈদ অপেক্ষা করছে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানদের জন্য। ঈদ শব্দটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষজন মেতে ওঠেন আনন্দ উদ্যাপনে। কারণ চড়াই-উতরাই পেরোনো জীবনে আমরা কতটুকুইবা সুযোগ পাই আনন্দে মেতে ওঠার। তাই তো এসব উপলক্ষ আমাদের ভরিয়ে দেয় নিরন্তর আনন্দধারায়। অথচ এবারের ঈদ যে অন্যবারের মতো অপার খুশিতে ভরিয়ে দিতে পারছে না। গত বছর করোনার মধ্যে প্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করে বিশ্ব। এরপর ঈদুল আজহাও উদ্যাপিত হয়েছে করোনার মধ্যে। যেখানে করোনার কারণে আনন্দ ছিল স্রিয়মান। এবারও বিশ্বের কয়েক কোটি মুসলমানের মনে ঈদের প্রকৃত আনন্দ নেই। প্রথমত করোনা নামক অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে সেই আনন্দ অনেকটা সাদামাটা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের চিত্র প্রায় একই রকম। এর বিরূপ প্রভাবে প্রায় থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। থেমে গেছে প্রায় ছয় শ কোটি মানুষের জীবনযাত্রাও। এমন পরিস্থিতির মূল কারণ প্রতিদিনই সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কঠিন এমন অবস্থা থেকে বিশ্ববাসী কবে নাগাদ মুক্তি পাবে তা কেউ বলতে পারছে না। কারণ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোনো শতভাগ সফল প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তাই করোনাভাইরাস বিষয়ে সবার মধ্যে কাজ করছে ভয়। আপাতত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকাটা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত সবার। তাই সেই পথেই হাঁটছে পুরো বিশ্ব।

বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ লেগেছে। এর ফলে প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। এমন বৃদ্ধির খবরে সবার মধ্যে কাজ করছে ভয়। করোনার কারণে এখন চলছে লকডাউন। করোনাময় লকডাউনের মধ্যেই দেশের মানুষ উদ্যাপন করবে ঈদুল ফিতর। গতবারের মতো এবারও মানুষ ঘরে বসে ঈদ উদ্যাপন করবেন। এখন লকডাউনের বাধ্যবাধকতা থাকায় সবার মনে রয়েছে ভয় আর উৎকণ্ঠ। কেননা, এখনো প্রতিদিন দেশে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে চলতি বছর মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ সময় মৃতের সংখ্যা এক শ অতিক্রম করে। আক্রান্তের সংখ্যাও সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। গত বছর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় মৃত্যু হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে করোনা নামক ভাইরাসে। এই ১৪ মাসে অনেক মানুষ তাদের প্রিয়জন হারিয়েছেন। কেউবা হারিয়েছেন বাবা, কেউবা মা। আবার অনেকে হারিয়েছে প্রিয় সন্তানও। নিকটাত্মীয় হারানোর সংখ্যাও কম নয়। প্রতিবেশীর মৃত্যুও দেখেছে অনেকে। পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় এখনো অনেকেই করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সময়ের স্রোতে চলে এসেছে ঈদুল ফিতর। এমন ভয় আর উৎকণ্ঠার মধ্যেই ঈদুল ফিতর উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তাই প্রতিবারের মতো এবার আর সবার মনে সেই অপার আনন্দ নেই। তবে যতটুকু আনন্দ আছে তা সীমিত পরিসরে পরিবারকে নিয়ে উদ্যাপন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা উচিত।

করোনার এমন খবরের মধ্যে আরো একটি দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে ভ্যাকসিন-স্বল্পতার বিষয়টি। ভারত কথামতো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন না দেওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে করোনার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন নেই। ভ্যাকসিন নিয়ে এমন শঙ্কা হওয়ার কারণ ভারত থেকে কেনা ও উপহার হিসেবে পাওয়া ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে আপাতত আর কোনো টিকাও দিচ্ছে না সিরাম। চুক্তি থাকলেও চাহিদার কারণে তারা টিকা দিতে পারবে না বলে জানিয়েছে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী যেভাবে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়া হচ্ছে, তাতে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে টিকা সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। সম্প্রতি সেই শঙ্কার কথাই জানিয়েছেন পুনের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা সরবরাহ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন। বেক্সিমকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের তথ্য অনুযায়ী আগাম টাকা দিয়ে টিকা কিনেছে বাংলাদেশ, সেরাম কোনোভাবেই টিকা আটকে রাখতে পারে না। বাংলাদেশ আগাম টাকা দিয়েছিল ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে। কথা ছিল ৬ মাস ধরে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতে বিপুল চাহিদার কারণে আটকে আছে এর পরের চালান। কবে নাগান ভ্যাকসিন আবারও পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত নয়। সিরামের এমন কর্মকা- কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে যখন অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে টিকার জন্য তখন সঠিক সময়ে টিকা দেওয়া উচিত ছিল সিরামের। তবে ভারত থেকে যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকা আসে সে বিষয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে এ কারণে যে দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনা। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। তাই মানুষ এখন দিন দিন করোনা টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী। কিন্তু এখন করোনা টিকার নেওয়ার ক্ষেত্রে বিপুল চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্তসংখ্যক মজুদ না থাকায় টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। নতুন করে প্রথম ডোজ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ায় সেই উদ্বেগ আরো বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে টিকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আগামী চার থেকে পাঁচ মাস পর তাদের টিকা বিক্রি বা রপ্তানি করার জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এখন প্রশ্ন হলো ভ্যাকসিনের জন্য যদি চার-পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হয়, তবে সেটা হবে আমাদের জন্য অস্বস্তির খবর। কারণ এরই মধ্যে লাখ লাখ মানুষ টিকা দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। ঠিক সময়ে এখন টিকা দিতে না পারলে মানসিকভাবেও অস্বস্তিতে থাকবে অনেকে। অথচ করোনাকালে মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটা বেশ জরুরি। সিরামের এমন কর্মকান্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঈদের আগে এমন খবর সবার মনেই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া করোনার কারণে অনেকে চাকরি হারিয়ে সংকটের মধ্যে রয়েছেন। তাদের মনেও ঈদের আনন্দ নেই।

এখন সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব টিকা আনার বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যতটা সম্ভব দেশের অধিকাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন প্রদানের আওতায় আনতে হবে। কারণ টিকা নেওয়া এখন সবার প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যবিদদের তথ্য অনুযায়ী দেশের অন্তত ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষকে দুই ডোজ করে টিকার আওতায় আনতে হবে। তবেই করোনা সংক্রমণ দূর করা সম্ভব হবে। কিন্তু এখন যদি করোনা ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না আসে তবে সেই লক্ষ্য পূরণ হবে না। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে টিকা আনার বিষয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতের টিকার পাশাপাশি চীন-রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাকসিন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যা শিগগিরই দেশে আসবে। দেশের নাগরিকদের জন্য করোনার টিকা আনার জন্য সরকারের আন্তরিকতা ইতিবাচক। ইতিবাচক খবর হলো টিকা উৎপাদনে যৌথভাবে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সই করেছে সরকার। এতে দেশের চাহিদা অনেকটা মেটানো সম্ভব হবে। সবার মনে স্বস্তিও ফিরে আসবে।

ঈদের আগে করোনার টিকা বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হলেও তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কেটে যাবে বলে বিশ্বাস। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া ও ভ্যাকসিন শেষ হয়ে যাওয়ার খবরের মধ্যে এসেছে খুশির ঈদ। তবে বাস্তবতা হলো প্রতি বছরের মতো এবারের ঈদুল ফিতরে সেই অপার আনন্দের বার্তা নিয়ে আসছে না এটা সত্যি। তবে এটাও সত্য বাঙালি এমনিতেই লড়াকু জাতি। সব সময় অনেক কিছুর সঙ্গে লড়াই করে জীবন ধারণ করেন। এবারও করোনার সঙ্গে লড়াই করে ঠিকই বিজয়ী হবে বাঙালি। এর জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই হয়তো কঠিন এই পরিস্থিতিতে ঈদের আনন্দ কিছুটা হলেও সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আর একটি কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে করোনার এমন সময়ে ঈদের আনন্দ উদ্যাপন করতে গিয়ে যেন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে ভুল না হয়। করোনা পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় এখনো সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদ,করোনা,করোনাভাইরাস,মহামারি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close