আবদুর রউফ

  ১৬ এপ্রিল, ২০২১

সহনশীলতা চর্চায় গড়ে উঠুক নবীন প্রজন্ম

মানবজীবনে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনুকরণীয় ও অনুশীলনযোগ্য একটি মহৎ গুণ। মানুষ চরিত্রগতভাবে জীবনে চলার পথে সহনশীলতা ধাপে ধাপে অর্জন করে। পরিবার, পরিবেশ কিংবা শিক্ষার মাধ্যমে এটি অর্জন করা যায়। কেউ জন্ম থেকে সহনশীল, কেউ শিল্প, সাহিত্য সাংস্কৃতি ও উদার মানসিকতার চর্চার মাধ্যমে এটি আয়ত্ত করতে পারে। মানবজীবনে সহনশীলতা মানুষকে শেখায় কীভাবে অন্যের মতামত ও আচার-আচরণ সহজভাবে গ্রহণ করতে হয়। ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে এবং সহযোগিতার মনোভাব বজায় রেখে একসঙ্গে বা একই সামাজিক পরিবেশে কীভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হয়। মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কাজকর্মে বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতা আসতেই পারে, সে কাজটি যদি মহৎ ও সৎ হয়, তাহলে সেই কাজটি সাফল্য অর্জনে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। জীবনের চলার ক্ষেত্রে সহনশীল হওয়ার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।

প্রথমত, সহনশীলতার চর্চা আমাদের পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। সন্তানদের এমন শিক্ষা দিতে হবে তারা যেন অসহনশীল আচরণ দিয়ে কারো অধিকার হনন না করে। কিছু তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারে বৃদ্ধ পিতা-মাতার সঙ্গে সহনশীল আচরণ না করে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা হয়। এই অসদাচরণ সন্তানদের সামনে করে। ফলে সেই সন্তান বড় হয়ে তার পিতা-মাতার সঙ্গে অসহনশীল আচরণ করে। যে পরিবারগুলোতে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমের রাখা হয় সাধারণত তাদের সন্তানরা পরবর্তীকালে তার পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখেন। যেহেতু পরিবার একটি শিশুর প্রথম বিদ্যালয়, পরিবারের সদস্য ও পিতা-মাতা তার প্রথম শিক্ষক, তাই তারা যে আচরণ শিখাবে শিশুরা সেটি শিখবে। আর পারিবারিক শিক্ষা থেকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ কখনো বের হতে পারে না। পারিবারিক শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে সাধারণত জীবনের পথ চলে। বাঙালি সমাজে পরিবারে কর্তারা একসময় আধিপত্যবাদী ছিলেন, এখনো অনেক পরিবারে লক্ষ করা যায়। যদিও নারীশিক্ষা ও নারীদের স্বক্ষমতায়ন অবস্থাটা কিছুটা পরিবর্তন আসতেছে, কিন্তু এখনো পুরুষ কর্তৃত্ব করতে চায়। শুধু পুরুষ নয়, বরং যে পরিবারের ব্যয়ভার বহন করে, সে মূলত কর্তৃত্ব বজায় রাখে, এটি আমাদের পারিবারিক নিয়ম। যত দিন পরিবারের সংজ্ঞায় কর্তৃত্ব কথাটি থাকবে, তত দিন পরিবারগুলো অসম্পূর্ণ থাকবে। তাদের মধ্য অপরের পছন্দ-অপছন্দ, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভারসাম্যের অভাব থাকবে। একটি পরিবার সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতার যাত্রা হতে পারে সহনশীলতার সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে। সহনশীলতা শেখায় পরিবারে কীভাবে পরস্পরকে সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসতে হয়। সেই সঙ্গে সহনশীলতা পরিবারের দায়িত্ব পালনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যরা যদি সহনশীল না হতেন, তাহলে অনেক পরিবারই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।

আদি সমাজের মানুষের মধ্যে একতা আর সহনশীলতার গল্প শোনা গেলেও বর্তমান সমাজে এটি নেই বললেই চলে। আমাদের সামাজিক আচরণে সহনশীলতা একবারে অনুপস্থিত। সমাজে যার যত শক্তি, হতে পারে সেটি পেশিশক্তি, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক, সেই ব্যক্তির মধ্য সহনশীলতা একদম লক্ষ করা যায় না। বর্তমান সমাজে ভিলেজ পলিটিকসের প্রভাবে ভিন্নমতের মানুষকে, মানুষ মনে করা হয় না। নানাভাবে সমাজে তাদের হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। সেই আদি বাঙালি স্বভাব যেন আজ হারাতে বসেছে। অনেকে সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের অধিকার হনন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। সহনশীল আচরণ কি জিনিস ক্ষমতার দাপটে তা আজ ভুলেই গেছে। পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক জীবনে সহনশীলতার চর্চা ফিরিয়ে নিয়ে আসা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একে অপরের প্রতি সহনশীল আচরণ অত্যন্ত জরুরি ও অত্যাবশ্যক। ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিক জীবনে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তথা বয়স্ক, বৃদ্ধ ও দুর্বল শ্রেণির প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহনশীল আচরণের শিক্ষা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে।

সামাজিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় জীবনে সহনশীলতার বড়ই অভাব। ক্ষমতাবানরা নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য সহনশীলতা নামে মানুষের জীবনে আচরণগত গুণ রয়েছে তা ভুলেই গেছে। সেই সঙ্গে আমাদের রাজনীতি থেকে তো সহনশীলতা একবারেই বিদায় নিয়েছে। টেলিভিশনের পর্দায় যদি ভিন্ন দলের কোনো নেতা বা কর্মী খুন হওয়া সংবাদ প্রচার হয় স্বভাবত আমরা আনন্দিত হই। অথচ একজন মানুষ বিনা বিচারে মারা গেল তা আমাদের মনেই আসে না। আসলে সহনশীলতার চর্চা না থাকার কারণে সেই খুন হওয়া মানুষটিকে মানুষ হিসেবে আমরা বিবেচনা করতেই পারি না। অমুক দলের লোক সে, মারা গেছে ভালোই হইছে, এমন মন্তব্য করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করি না। বিশ্বব্যাপী নিজেদের ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে অসমপ্রতিযোগিতা শুরু হয়ে তা সত্যিই হতাশাজনক। ভিন্নমতকে দমন করার জন্য পৃথিবীব্যাপী যে অসহনশীলতার চর্চা শুরু হয়েছে, তা সত্যিই দুঃখজনক। স্বাধীন দেশে ভিন্নমত থাকবে, সমলোচনা থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। নিজের ক্ষমতার শক্তি প্রমাণে তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলোর ওপর যে হত্যা নির্যাতন চালাচ্ছে বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন তাদের সর্বোচ্চ সহনশীল হওয়া দরকার ছিল।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত শাসনব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। অথচ বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা উঠিয়ে যাওয়া অন্যতম কারণ হলো, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের আচরণ মোটেও সহনশীল নয় বরং স্বৈরাচারী। তাই রাষ্ট্রের কাঠামোয় সহনশীলতা প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থে। গণতন্ত্র মানেই পরমতসহিষ্ণুতা, নিজের বা নিজ দলের বাইরের মানুষের অধিকার মেনে নেওয়া। বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সেটি নেই বললেই চলে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সহনশীলতা প্রয়োজন শুধু যে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে বা বজায় রাখতে তা নয়, বরং সবার কর্মক্ষমতা বাড়াতেও। সহনশীল পরিবেশ মানুষের কাজের স্পৃহা ও ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। সবাই একে অপরকে মূল্য দিতে, সম্মান করতে শেখে, তাতে লাভ হয় প্রতিষ্ঠানের। একজন সহনশীল মানুষ অন্যের শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালোবাসা পায়, কিছু না হলেও ঝগড়াঝাঁটির বাইরে থেকে নিজের মনের শান্তি ধরে রাখতে পারে। তাই বিশ্বব্যাপী একে অপরের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধিতে সহনশীলতা চর্চার বিকল্প নেই।

তবে সহনশীলতা যে একবারে নেই, তা কিন্তু নয়। সহনশীলতা আছে এবং ভালোভাবেই আছে। যদি সহনশীল আচরণের ভালো মানুষ দুনিয়ায় না থাকত তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। সমস্যা হয় মূলত, আমাদের সমাজে সহনশীল যারা, তারা সাধারণত দুর্বল শ্রেণী। এ কারণে যারা শক্তিমান, তারা এটিকে দুর্বলতা ভাবেন। আমাদের মায়েরা সহনশীল, তঁরা সহনশীল না হলে পরিবারে ভাঙন ধরত। আমাদের পিতারা সহনশীল, তারা কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারকে আগলিয়ে রাখেন। সেই সঙ্গে আমাদের কৃষক সমাজ সবচেয়ে বেশি সহনশীল, বারবার তাদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য না পেয়েও অন্য মৌসুমে ভালো মূল্য পাবে এই আশায় বুক বাঁধে। এত শ্রম ও কষ্টের উৎপাদিত ফসল বন্যায় বা বেড়িবাঁধ ভেঙে ভেসে গেলেও, খরায় শুকিয়ে গেলেও তারা সহ্য করে নেন। দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অবদান রেখে চলেছেন আমাদের সহনশীল কৃষক সমাজ। আমাদের দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ খুবই সহনশীল, প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রীয় সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও নিজেদের পরিবারের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। হাজারো দুঃখ বুকে চেপে নিরলসভাবে সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণি অনেক সহনশীল। সময়মতো বেতন-বোনাস না দিলেও মালিকদের শোষণ ও নিপীড়ন সহ্য করে প্রতিনিয়ত উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখছেন। আমাদের সমাজের সর্বোচ্চ মানুষ যারা এই নিম্ন আয়ের মানুষদের সহনশীলতার সুযোগ নিয়ে অর্থ উপার্জন করে যাচ্ছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া গরিব শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সহনশীলতা চর্চা থাকলেও শিক্ষিত ধনীদের মধ্যে তা নেই। অথচ হেলেন কেলার বলতেন, শিক্ষার সর্বোচ্চ ফল হচ্ছে সহনশীলতা। সেই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ সহনশীলতার মতো মানুষের জীবনের এই মহৎ গুণটি অর্জন করতে ব্যর্থ।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সহনশীলতা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম মানুষকে সহনশীল হওয়ার ব্যাপারে নির্দেশ করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বিপদে ধৈর্যধারণের কথা বলেছেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা ধৈর্য-সহনশীলতা ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত : ১৫৩)। এই সহনশীল আচরণ মানুষকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এমন বার্তা আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার উম্মতকে দিয়েছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সহনশীলতার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে সহনশীলতা অবলম্বনের শক্তি দান করবেন, আর সহনশীলতা থেকে অধিক উত্তম ও ব্যাপক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।’ (বুখারি ও মুসলিম)। তাই নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সহনশীলতার চর্চা পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিজীবনে সহনশীলতা চর্চার মধ্য দিয়ে উত্তম ও মানবিক চরিত্রের অধিকারী হওয়া সম্ভব। তাই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে একটি শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। মানুষের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সহনশীল হওয়ার বাণী ছড়িয়ে পড়ুক, সে প্রত্যাশা রইল।

লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নবীন প্রজন্ম,সহনশীলতা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close