এস এম মুকুল

  ১৬ এপ্রিল, ২০২১

অর্থনীতিতে মধুর আশাবাদ

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রায় প্রত্যেক ঋতুতে কোনো না কোনো ফুল ফোটে। আর এসব ফুল থেকে মধু আহরণের বিরাট সুযোগ রয়েছে। এ কারণে মৌচাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী আমাদের বাংলাদেশ। একটা সময় মধু আহরণ ছিল শুধু সুন্দরবনকেন্দ্রিক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মধু উৎপাদন, ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণে। এখন মধু চাষ হয় ব্যাপকভাবে। দেশে মধুর উৎপাদন ও বহুমাত্রিক ব্যবহার বেড়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধু এখন রপ্তানি পণ্যতালিকায় নাম লিখিয়েছে। দেশের মৌচাষিরা রপ্তানির জন্য বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষ করছেন। দেশে এখন সাত হাজার চাষি দুই হাজার মৌ খামারে বছরে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টন মধুর জোগান দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত প্রযুক্তি ও মৌচাষির সংখ্যা বাড়ালে মধুর উৎপাদন বছরে ১ লাখ টন উৎপাদন সম্ভব।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৭ সাল থেকে মৌ-বাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ শুরু হয়। তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, সুন্দরবনের মধু আহরণ ছাড়া সরিষা ফুল থেকে সবচেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ করা হলেও লিচু, কালিজিরা, মৌরি, ধনিয়া, তিসিসহ বিভিন্ন ফুলের মধুও সংগ্রহ করেন মৌচাষিরা।

বাংলাদেশের মধু একটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী খাত। দেশে বর্তমানে দুই প্রজাতির মৌমাছির দ্বারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ-বাক্সে চাষ করা হয়। মৌচাষ বিশেষজ্ঞ ও কৃষি গবেষকদের মতে, ফসলের মাঠে মৌমাছি বিচরণ করলে সেখানে বাড়তি পরাগায়নের কারণে ফসলের উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে। তার মানে মৌচাষের মাধ্যমে মধু আহরণে লাভ দুটি ১. অর্থকরী খাত হিসেবে মধু আহরণে সমৃদ্ধি, ২. শষ্য বা মধুভিত্তিক কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি। অথচ অধিকাংশ কৃষকের এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে চাষি পর্যায়ে এ ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সুন্দরবনের পাশাপাশি পেশাদার মৌচাষিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমে মৌসুমে সরিষা, ধনিয়া, তিল, কালিজিরা, লিচু এসব ফসলের জমিতে বা বাগানে মৌ-বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করে। আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষ করে শত শত টন মধু উৎপাদন করা হচ্ছে। এর ফলে মধু আহরিত শস্য যেমন সরিষা, তিল, কালিজিরা, লিচু ইত্যাদিও ফলনও বেড়েছে অনেক গুণ। মৌচাষিরা বিভিন্ন ঋতুতে তাদের মৌ-বাক্সে নিয়ে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সাভার, দিনাজপুর, রাজশাহী, বরগুনা ও সুন্দরবনের সাতক্ষীরায় মধু সংগ্রহে চলে যান। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেখানে তারা অবস্থান করেন এবং মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসেন। সংগ্রহকারীর কেউ কেউ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মধু বিক্রি করেন। বড় খামারিরা সংগৃহীত মধু প্রসেসিং প্লান্টে পরিশোধন করে বাজারজাত করেন। সরিষা, লিচু, তিল ও কালিজিরা ফুল থেকে সংগৃহীত মধু আলাদা আলাদাভাবে বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ১০ হাজার টনের বেশি মধু উৎপাদিত হয়েছে। চলতি ২০১৭ সালে প্রায় ১৫ হাজার টন মধু উৎপাদন করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী ২০২০ সাল নাগাদ দেশে ১ লাখ টন মধু উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিক।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে মধু উৎপাদনে সরাসরি জড়িত প্রায় ১৮ হাজার মৌচাষিসহ মধু শিল্পে জড়িত প্রায় ২ লাখ মানুষ। উৎপাদন প্রায় ৬ হাজার টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়। ২০ হাজার হেক্টর জমিতে কালিজিরা, ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে ধনিয়া, ২০ হাজার হেক্টর জমিতে তিল ও বিপুল পরিমাণ জমিতে লিচু উৎপাদিত হয়। এই পুরো সেক্টরটিকে মধু আহরণের আওতায় আনতে পারলে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে অনেকের ধারণা। দেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়। তার মাত্র ১০ শতাংশ থেকে এখন মধু সংগ্রহ করা যাচ্ছে। পুরো সরিষার মাঠ মধু সংগ্রহের আওতায় আনা গেলে উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব। তবে আশার খবর হলো লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিকের আওতায় মৌচাষ সংক্রান্ত মধু উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বিষয়ক একটি প্রকল্প মৌচাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মানসম্পন্ন মৌ-বাক্স সরবরাহ করে।

বিশ্ববাজারে মধু বাণিজ্য এখন বেশ জমজমাট। বাংলাদেশেও মধুর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশি উদ্যোক্তারা মধু উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত মধুর ব্যবসা দেশের বাজারে দ্রুত প্রসার লাভ করছে। কিন্তু বিস্ময়ের খবর হলো ঢাকা ও বিদেশের বাজারে বেশি বিক্রি হওয়া ভারতের ডাবর ব্র্যান্ডের ‘ডাবর হানি’ মধু কিনে নেয় বাংলাদেশ থেকে। তার মানে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডেড কোম্পানিগুলোর সামনে অনেক সম্ভাবনা আছে এই মধু শিল্পকে কেন্দ্র করে। দেশে উৎপাদন বাড়ার ফলে মধু রপ্তানির বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫০ টন বা ৫৫ কোটি টাকার মধু ভারত, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে। আগামী ২০২০ বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে রপ্তানি হবে শতকোটি টাকার মধু। মধু রপ্তানির অপার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বিসিক চলতি ২০১৭ সাল থেকে মৌচাষের ব্যাপক সম্প্রসারণের কর্মসূচি নিয়েছে।

জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মধু রপ্তানি হয়। বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপে বাংলাদেশের মধু বিপণনের লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ স্লোভেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী মধু উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেডেক্সের সঙ্গে বিসিকের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মধু রপ্তানিকারক দেশটির নাম চীন। মধু রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশ আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো। সবচেয়ে বেশি মধু আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জাপান। নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের মধু এখন বিশ্বের বেশ কিছু দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি ২০১৪ সাল থেকে ভারতে ও জাপানে মধু রপ্তানি করছে। বাংলাদেশের মধু চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এখন চেষ্টা চলছে ইউরোপে রপ্তানির। বিসিএসআইআরের ল্যাবরেটরিতে বাংলাদেশি মধু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আমাদের দেশের মধুর গুণগত মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। অলওয়েলস মার্কেটিং নামের একটি কোম্পানি ভারতে মধু রপ্তানি করে এবং এই কোম্পানির মধুর ব্র্যান্ডের নাম ‘ট্রপিকা হানি’। আয়ুর্বেদিয়া ফার্মাসি (ঢাকা) লিমিডেট জাপানে মধু রপ্তানি করছে। বাংলাদেশের বাজারে তাদের ব্র্যান্ডের নাম এপি মধু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনা কাজে লাগালে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর এক থেকে দেড় লাখ টন মধু বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।

কৃষি ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী, উদ্ভিদের পরাগায়নে মৌমাছির গুরুত্ব অপরিসীম। মৌমাচির মাধ্যমে বাক্স পদ্ধতিতে মধু চাষের কারণে কৃষি খাতে উৎপাদন ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের ধারণা স্পষ্ট নয়। তাই মধুভিত্তিক শস্য সরিষা, তিল, তিসি, লিচু ইত্যাদির কৃষিজ উৎপাদন বাড়াতে মৌচাষ এবং মৌচাষের উপকারিতা সম্পর্কে স্থানীয় কৃষি অফিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা জরুরি। আশার খবর হচ্ছে সরকার ২০১২-১৭ মেয়াদে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় মৌচাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং মৌচাষিদের বিসিক থেকে সহজ শর্তে ৯ শতাংশ সরল সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদিত মধুর জনপ্রিয়তা বাড়াতে বিসিক বিভিন্ন সময় মেলার আয়োজন করছে। মৌ-বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মৌচাষে উন্নতি প্রযুক্তির প্রয়োগ, চাষিদের প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ এবং একই সঙ্গে মৌচাষির সংখ্যা বাড়ালে বছরে ১ লাখ টন মধু উৎপাদন করা এবং বিপুল পরিমাণ মধু বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।

আমরা জানি, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন এবং বাইবেলে মানবদেহে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে মধুর গুরুত্বপূর্ণ কার্যকারিতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সুস্থ জীবন ও রোগমুক্ত শরীরের জন্য মধুপানের গুরুত অনেক। সুস্থ শরীরের জন্য সবার মধুপানের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে প্রচারণা চালালে দেশে মধুর বিরাট বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে কৃষকের প্রশিক্ষণ, সহায়তা, মনিটরিং, মধু সংরক্ষণ ও প্যাকেজিংয়ের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অর্থনীতি,মুক্তমত,মধু
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close