রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৪ এপ্রিল, ২০২১

মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় মাহে রমজান

রমজান মুসলিম জাতির জন্য বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ মাস। রোজা এক মাসের কিন্তু শিক্ষা ১২ মাসের। রমজান রহমতের ফল্গুধারা। রোজা ইবাদতের দরজা। রোজা শরীরের জাকাত। রোজা জীবনের পরিবর্তন আনে। রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির সওগাত নিয়ে মুসলিম মিল্লাতের কাছে আগমন করেছিল সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। এ পবিত্র মাস সহমর্মিতা, সংযম, ধৈর্য ও প্রতিরোধের সুমহান বার্তা নিয়ে আগমন করেছিল। একে একে পরিপূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে মাহে রমজানের রুপালি চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণ। পুণ্যাশ্রয়ী জীবন গঠন ও সত্যনিষ্ঠতার বাস্তব অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে মাহে রমজানের দিনগুলো। রোজা বাস্তবিকই আত্মিক নিয়মানুবর্তিতার একটি উপায়, যা মানুষকে নৈতিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়। এমনিভাবে মাহে রমজানের মূল্যবোধ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, সংযম, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। তাই রোজা এক মাসের কিন্তু শিক্ষা ১২ মাসের। রমজান মাসে রোজাদারদের মধ্যে যে মানবিক মূল্যবোধ, আত্মিক, নৈতিক, আদর্শিক ও চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত হয়, তা যদি সারা বছর অব্যাহত থাকে, তাহলে এ সমাজ শান্তির সমাজে পরিণত হতে পারে। এক মাস সিয়াম সাধনা আর আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পৃথিবীর মোমিন মুসলমানরা ঈমানি চেতনা জাগ্রত করে নেবে।

মুসল্লিদের সাহ্রি খাওয়া, তারাবির নামাজ পড়া, ইফতারি খাওয়া ও বিভিন্ন ইফতার পার্টির আয়োজন হবে। মসজিদে মসজিদে নামবে মুসল্লিদের ঢল। অনেকেই তাদের জাকাত আদায় করবেন, অসচ্ছল মানুষদের বস্ত্র ও অন্য পণ্যসামগ্রী বিতরণ করবেন এবং বাড়তি আমল করার চেষ্টা করবেন। সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম এক আবহ বিরাজ করবে পুরো রমজান মাসে। পবিত্র রমজান মাসে পাল্টে যাবে মানুষের যাপিত জীবনধারা। রোজার মাধ্যমে সংযম সাধনায় প্রকৃত লক্ষ্যই হলো তাকওয়া অর্জন। আর তাকওয়া অর্জন করলেই সমাজ থেকে সব ধরনের অন্যায়-অবিচার দূর হবে। সমাজ হবে অপরাধমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত। আদর্শ সমাজ গঠনের প্রধান শর্ত হচ্ছে মানুষের আত্মশুদ্ধি। মানুষের অন্তরাত্মা যখন কদর্যমুক্ত হবে; তখনই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কোনো মানুষের মধ্যে যদি খোদাভীতি ঢুকে পড়ে, তখন সে মানুষ অপরাধ করতে পারে না। রোজা মানুষের মধ্যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারণ রমজানের রোজা মানুষ একমাত্র আল্লাহর প্রতি শতভাগ আনুগত্য প্রকাশের জন্যই পালন করে। যে কেউ ইচ্ছা করলেই লোকচক্ষুর অন্তরালে পানাহার করতে পারে এবং অন্য মানুষের সামনে নিজেকে রোজাদার বলে প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু প্রকৃত রোজাদার তা করেন না। তার একমাত্র কারণ এ রোজাদাররা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্যই রোজা রাখেন। রোজার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং তাকওয়া অর্জিত হয়, তা যদি সারা বছর বিদ্যমান থাকে, তাহলে এ মানুষের দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব।

রোজা মানুষকে মিথ্যা বর্জন করে ও সত্য বলতে অভ্যস্ত করে। মাহে রমজান সমাগত। পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতি বছর বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে এ মাসটি মুসলমানদের কাছে হাজির হয়। রমজান আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাস। এ মাসে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করে। এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পরবর্তী ১১ মাস যাতে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি সহকারে চলতে পারে, সে চেষ্টাই করে থাকে। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই রমজান মাসকে কেন্দ্র করে অতি মুনাফা লাভের আশায় দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, ঠিক সেভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না। রমজান সামনে রেখে প্রতি বছর পণ্যের দাম বাড়ে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই পণ্যের দাম বেড়ে চলছে। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক।

রমজান সহমর্মিতার মাস। একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা রমজানের মহান শিক্ষা। হাদিস শরিফে এসেছে রোজাদারের সঙ্গে গায়ে পড়ে যদি কেউ ঝগড়া করতে আসে, রোজাদার বলবেন আমি রোজা রেখেছি। রমজান সিয়াম সাধনার মাস। অভাবী মানুষেরও প্রত্যাশা থাকে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে; যাতে তারা নির্বিঘেœ রমজান পালন করতে পারেন। বিশ্বের অনেক দেশেই রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়। কিছু কিছু দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়েও দেওয়া হয় যেমন সৌদি আরব, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে পণ্যের দাম কমিয়ে রোজাদারদের নির্বিঘ্নে প্রশান্তি সহকারে সিয়াম সাধনার সুযোগ করে দেওয়া হয়। সহমর্মিতার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও ক্রেতাসাধারণের হাতের নাগালে রাখা ও ওজনে কম না দেওয়া। ইসলাম শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। এর মূল বাণীই হচ্ছে মানবতার উৎকর্ষ, আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য আর মানুষসহ সব সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা। পবিত্র রমজানে মুসলমানদের জীবন-জীবিকার সর্বত্র সততা, সংযম ও পবিত্রতার ছোঁয়া লাগবে এটাই স্বাভাবিক।

চলতি বছর রোজাকে সামনে রেখে এমন একসময়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, যখন করোনা মহামারির কারণে দেশের বেসরকারি খাতের চাকরিচ্যুতি, বেতন হ্রাস ও অন্যান্য কারণে মানুষের আয় কমেছে, বেড়েছে দারিদ্র্য হার। খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। রমজানে বহুল ব্যবহৃত পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে মুনাফা করবেন, তা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু রমজান মাসে ভোক্তাদের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে অতি মুনাফা করবেন, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। প্রতি বছর, প্রতি মাস এবং প্রতিদিনেও জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি আরো জোরদার করতে হবে। দেশপ্রেম ও মানবিকতা এবং তাকওয়া সহকারে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করলে কোনো মানুষ অতি মুনাফা করার জন্য সচেষ্ট হবে না এটাই রমজানের শিক্ষা।

বিবেক বর্জিত, মূল্যবোধহীন মানুষ সব দেশে, সব জাতির মধ্যেই কম-বেশি আছে। বাঙালি জাতির মধ্যে সে সংখ্যাটা একটু বেশি। নইলে দেশের বা জাতির আজ এই মুমূর্ষু দশা হতো না। মানবিক মূল্যবোধের চর্চাই পারে মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে সাহায্য করতে। বাহ্যিক সৌন্দর্যের পরিচর্যার পাশাপাশি অন্তরের সৌন্দর্যেরও পরিচর্যা করা উচিত। জাগ্রত মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ কখনো অন্যায় করতে পারে না, কখনো তার দ্বারা অপরের ক্ষতি হতে পারে না। বিবেককে সঙ্গী করে যে সুবোধ তৈরি হয়, তা দ্বারা মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে না। তাই প্রত্যেকের উচিত মানবিক মূল্যবোধের চর্চা করা। তবেই বদলে যাবে জাতি, বদলে যাবে দেশ। বিকশিত হবে রমজানের মাহাত্ম্য।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাহে রমজান,মূল্যবোধ,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close