মো. জিল্লুর রহমান

  ১২ এপ্রিল, ২০২১

আশার আলো দেখাচ্ছে প্লাজমা থেরাপি

বিশ্বজুড়ে চলছে করোনাভাইরাসের তান্ডব এবং প্রথম ঢেউয়ের মতোই দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু বিশ্বজুড়ে নানা দেশে টিকা গ্রহণ করার পরও অনেকে সংক্রমিত হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে এবং এ কারণে কোন টিকা কতটা কার্যকর, সে প্রশ্ন অনেকের মনেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তবে আবিষ্কৃত কোনো টিকাই রোগী আক্রান্ত হলে তার ক্ষেত্রে একেবারেই কাজ করছে না। ফলে গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীদের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকরা এখন ভরসা করছেন কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপির (সিপিটি) ওপর।

চীনে প্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়, যা একটি শ্বাসযন্ত্রের রোগ। জ্বর দিয়ে শুরু হয় এবং পরে শুকনো কাশি হয়। এক সপ্তাহ পর এটি শ্বাসকষ্টের দিকে নিয়ে যায় এবং কিছু রোগীর হাসপাতালের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় করোনার হাজারও ধরন চিহ্নিত হয়েছে এবং এটি প্রতিনিয়ত এর রূপ বদলাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে বেশ কয়েকটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এই টিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও মডার্না এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথভাবে উদ্ভাবিত টিকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরেই ফাইজার বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন জরুরি প্রয়োগের অনুমতি দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু ফাইজার বা মডার্নার চেয়ে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন দামে কম ও সহজে বিতরণ করার সুবিধার জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, নিরাপত্তার জন্য আবশ্যক সব মানদন্ড রয়েছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের এবং এটি গ্রহণে ঝুঁকির চেয়ে উপকার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অভ্যন্তরীণ প্যানেলের সুপারিশের ভিত্তিতে টিকাগুলো প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের ব্যবধানে সব প্রাপ্তবয়স্কের জন্য দুটি ডোজ প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া করোনা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও ভ্যাকসিনগুলো প্রয়োগ করা যাবে।

কিন্তু আবিষ্কৃত কোনো টিকাই রোগী আক্রান্ত হলে তার ক্ষেত্রে একেবারেই কাজ করছে না। এ কারণে বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসা করার প্রয়াসও অব্যাহত রেখেছে। চিকিৎসকরা সে রকমই একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে করোনার চিকিৎসায় প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছেন। ডাক্তারি ভাষায়, এই পদ্ধতির নাম হলো প্লাজমা থেরাপি। প্লাজমা হলো রক্তের জলীয় উপাদান। বাংলায় বলা হয় ‘রক্তরস’। সহজে বলা যায়, যাদের করোনা হয়েছিল এবং সেরে উঠেছেন, তাদের শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি তৈরি হয় বা রক্তে প্রোটিন জাতীয় পদার্থ তৈরি হয়, যা ওই ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে। প্লাজমা পদ্ধতির অর্থ হলো, ওই ব্যক্তিদের রক্ত থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করে করোনা আক্রান্তের শরীরে দেওয়া। যাতে রোগীর শরীরেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।

প্লাজমা হলো রক্তের তরল অংশ; যা যখন সব লাল এবং সাদা রক্তকণিকা এবং প্লাটিলেটগুলো সরিয়ে ফেলার পর থাকে। সিপিটিতে, সুস্থ হওয়া রোগীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্লাজমা বর্তমানে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে ব্যবহার করা হয়। আসলে প্লাজমাতে থাকে নানা দরকারি প্রোটিন, রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর আর থাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন, যাকে আমরা অ্যান্টিবডি বলি। আর এই প্লাজমা একই ভাইরাসে আক্রান্ত অন্য একজনের শরীরে শিরাপথে প্রবেশ করিয়ে যে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকেই বলা হয় ‘কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’। যেহেতু এই প্লাজমায় ভাইরাসপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি আছে এবং তা সেরে ওঠা একজন রোগীর শরীর থেকে সংগ্রহ করে অন্য একজন আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করা হয়, সে কারণে একে ‘প্যাসিভ অ্যান্টিবডি থেরাপি’ও বলা যায়। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, এজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেকটিন, ফ্যাপিরাভির, রেমডিসিভির, প্লাজমা থেরাপি ইত্যাদি দিয়ে করোনার চিকিৎসায় ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো পর্যন্ত করোনার চিকিৎসায় বেশ কয়েকটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে। তার পরও করোনার চিকিৎসায় কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি আশাব্যঞ্জক ফল দিচ্ছে।

তবে মনে রাখা দরকার, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যত টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে তার কোনোটিই সংশয় ও শঙ্কামুক্ত নয়। প্লাজমা থেরাপির ট্রায়ালগুলো থেকেও এখন পর্যন্ত খুব আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায়নি। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তাদের চিকিৎসা নীতিমালা থেকে প্লাজমা থেরাপি তুলে নিয়েছে। তবে পরীক্ষামূলক ব্যবহার চলতে পারে বলে জানিয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) অবস্থানও তাই। ২০২০ সালের ২৫ এপ্রিল কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সিপিটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) ৪ এপ্রিল, ২০২০ সিপিটি অনুমোদন করেছে। যেহেতু এটি পরীক্ষামূলক, তাই এতে রোগী বা রোগীর বৈধ অভিভাবকের লিখিত সম্মতির প্রয়োজন হয়। এটি যে পরীক্ষামূলক এবং আরোগ্যের নিশ্চয়তা দেয় না, এ বিষয়টিও পরিষ্কার করতে হবে।

কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি কিন্তু একেবারেই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। অষ্টাদশ খ্রিস্টাব্দে এ চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন হয়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম ডিপথেরিয়া রোগের চিকিৎসা দিয়েই এ পদ্ধতির গোড়াপত্তন হয়। শুরুর দিকে কোনো পশুকে আক্রান্ত করে সেটির শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করা হতো। পরে জটিলতার কারণে মানব শরীরের প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়। জার্মান ফিজিওলজিস্ট এমিল ফন বেহরিং প্রথমে থেরাপি হিসেবে প্লাজমা ব্যবহার করার ধারণাটি চালু করেন। তিনি ডিপথেরিয়ার বিরুদ্ধে প্লাজমা সিরাম থেরাপির ব্যবহার করে ১৯০১ সালে ফিজিওলজিতে প্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। পরে ১৯২০ সালে এই প্লাজমা স্কারলেট ফিভার চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত হুপিং কাশি রোগের চিকিৎসা এ প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমেই দেওয়া হয়। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির সময় এই কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপর হাম, মাম্পস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, জলবসন্তের চিকিৎসায়ও প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়। যদিও ফল ছিল মিশ্র প্রকৃতির। সিপিটি এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পুরোনো চিকিৎসা, যা নিকট অতীতে ২০০৩ সালে সার্স, ২০০৯ সালে বার্ড ফ্লু, ২০১২ সালে মার্স করোনাভাইরাস এবং অতি সম্প্রতি ২০১৩ সালে ইবোলা ভাইরাস চিকিৎসায় কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন এমন যেকোনো ব্যক্তিই হতে পারেন সম্ভাব্য প্লাজমা ডোনার বা প্লাজমাদাতা। আগে কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন আর এখন পরপর দুবার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হয়েছেন এবং নেগেটিভ হওয়ার পর কমপক্ষে ১৪ দিন (কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৮ দিন) কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি এমন ব্যক্তিই হতে পারেন প্লাজমাদাতা। প্লাজমাদানের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, তার শরীরে যথেষ্টমাত্রায় অ্যান্টিবডি উৎপাদিত হয়েছে কি না। এজন্য অ্যান্টিবডি টাইটার পরীক্ষা করা হয়। আমাদের দেশের নীতিমালা অনুযায়ী ১ : ১৬০ টাইটার হলে প্লাজমা থেরাপির জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনের অন্যান্য শর্ত যেমন রক্তবাহিত রোগের (সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, এইচআইভি ইত্যাদি) উপস্থিতি, প্লাজমাদাতার ওজন, রক্তচাপ, গর্ভাবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখতে হয়।

একজন দাতার শরীর থেকে একবারে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিলিটার প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। অ্যাফেরেসিস যন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দাতার শরীর থেকে পুরো রক্ত না নিয়ে শুধু প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। একজন দাতার প্লাজমা দিয়ে তিন ইউনিট পর্যন্ত (প্রতি ইউনিট ২০০ মিলিলিটার) প্লাজমা বানানো যায়। দাতা চাইলে একবার প্লাজমা দেওয়ার পরের সপ্তাহে আবারও প্লাজমা দিতে পারেন। প্লাজমা দান করার পর ২৪ ঘণ্টায় তিন লিটার পানি পান করলেই এর অভাব পূরণ হয়ে যায়। তাই দাতার এ ক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) অধীনে প্লাজমা চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় উপকমিটি গঠন করা হয় এবং ২৮ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সিপিটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে ডিজিএইচএসকে সারা দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও তদারকি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভারতসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ চিকিৎসার অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এ থেরাপি সফল হয়েছে এবং আমাদের দেশেও পরীক্ষামূলকভাবে এটি সফল হয়েছে। তবে এটি সফলভাবে প্রয়োগ ও ব্যবহারের জন্য একটি সুষ্ঠু প্লাজমা নীতিমালা তৈরি ও অনুমোদন খুবই দরকার।

অবশ্য প্লাজমা থেরাপিতে তেমন কোনো ঝুঁকি এখনো পাওয়া যায়নি। তবে রক্ত বা রক্ত উপাদান পরিসঞ্চালনের যেসব ঝুঁকি আছে, তা এখানেও প্রযোজ্য। যেমন অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া, রক্তবাহিত জীবাণু সংক্রমণ, পরিসঞ্চালনজনিত ফুসফুসের সমস্যা ইত্যাদি। যাদের এ ধরনের সমস্যা আছে, তাদের প্লাজমা না দেওয়াই ভালো। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে দাতার প্লাজমা দানে এগিয়ে আসতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। দাতাদের কাছ থেকে যত বেশি প্লাজমা পাওয়া যাবে, ততই সিপিটি ব্যবহার করে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করা সহজ হবে এবং কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আশার আলো ততই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্লাজমা থেরাপি,মুক্তমত,টিকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close