এস এম মুকুল

  ১১ এপ্রিল, ২০২১

প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ ও পৃষ্ঠপোষকতা

প্রকাশনাকে শুধু একটি শিল্প হিসেবে দেখলে ভুল হবে। জাতি গঠনে এবং সৃজনশীল সংস্কৃতির সম্প্রীতি ঘটাতে এ শিল্পের ভূমিকা অগ্রগণ্য। এমন একটি শিল্পের প্রতি সরকারের উদাসীনতা কাম্য হতে পারে না। সৃজনশীল প্রকাশনার প্রথম ক্রেতা হতে হবে সরকারকে। সরকার ক্রেতা হয়ে বই পঠনকে জনপ্রিয় করে তুললে প্রজন্মের মাঝে সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব তৈরি হবে। সামাজিক অসংগতি ও সংঘাত কমবে। এ কাজে সরকারেরই লাভ বেশি। এস এম মুকুল বইমেলা এখন আমাদের প্রাণের মেলা। এ মেলার সঙ্গে আমাদের ভাষা ও বর্ণমালার যোগসূত্র। বইয়ের সঙ্গে মানুষের প্রীতিময় সম্পর্র্ক অত্যন্ত নিবিড় এবং প্রাচীন। বই পড়ার অভ্যাস সারা বছরের বিষয় হলেও বই পড়ার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পায় যেন বইমেলায় এসে।

আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার সর্বোত্তম জায়গা পরিবার। সেখান থেকেই তৈরি হওয়ার কথা বইপড়ুয়া প্রজন্ম। সময়ের সঙ্গে আমরা যেন সংস্কৃতিচর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। অপসংস্কৃতির ভর আমাদের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। এ কারণে সমাজে ফুলেফেঁপে উঠছে অস্থিরতা। শূন্যতা, হাহাকার ধ্বংস করতে বসেছে আমাদের সৃজনী-ক্ষমতা আর মানবিক মূল্যবোধ। তবু এ কথা সত্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে এসব জরাজীর্ণতার মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে লাখ লাখ তরুণ পাঠক। বইয়ের মাধ্যমে বোধ পরিবর্তনের এ আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে আমাদের বাংলা একাডেমি; লেখক, প্রকাশক সর্বোপরি প্রাণের প্রিয় এ বইমেলা। বইমেলার মধ্য দিয়ে বই কেনা, উপহার দেওয়া এবং বই পড়ার অভ্যাস বাড়ে। এ ধারাবাহিকতা আমাদের এগিয়ে নিচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পাঠক ধরে রাখা এবং নতুন পাঠকশ্রেণি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রকাশক, লেখক ও বাংলা একাডেমিকে নতুন যুগোপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলা একাডেমি অমর একুশে বইমেলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিণত। একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সূত্রে এ স্থানটির প্রতি মানুষের আবেগ-অনুভূতি কাজ করে। বইমেলা বলতে এখন দোয়েল চত্বরসংলগ্ন বাংলা একাডেমিকেই বোঝায়। রিকশাচালক থেকে শুরু করে সবাই স্থানটিকে চেনেন এই পরিচয়ে। নিরাপত্তার দিক দিয়েও জায়গাটি ভালো। বিভিন্ন কারণে জাতির কাছে এ জায়গাটির অন্যরকম এক গুরুত্ব এবং আবেদন আছে। কয়েক বছর ধরে বইমেলার জন্য বিকল্প স্থানের কথা বলাবলি হচ্ছে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিযুক্ত মতান্তরও রয়েছে। এবার তাই মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

বই প্রকাশ, বইমেলা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা শিল্পটি লেখক-প্রকাশকদের মিলনমেলায় পরিণত। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রকাশনা শিল্পকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসা, বইমেলার সফল আয়োজন এবং লেখক সৃষ্টিতে প্রকাশকদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সে হিসেবে প্রকাশকরা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী মূল্যায়ন পাচ্ছেন? এই বাংলাবাজারের প্রকাশনালয়ে এমন সব প্রকাশক রয়েছেন যারা এক জীবনে এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি অসংখ্য জনপ্রিয় লেখক তৈরি করেছেন। সেসব প্রকাশকের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই। একজন সংগীতশিল্পীর যেমন সম্মান আছে, তেমনি আছে একজন গীতিকারের। তাহলে লেখকের স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রকাশকের স্বীকৃতি সময়ের দাবি। বলা প্রয়োজন অনেক প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তারা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখকের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্র করেন না। বই প্রকাশের প্রকৃত সংখ্যার তথ্য গোপন করেন। লেখককে তার প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী দিতে চান না। লেখকের অনুমতি ছাড়া পুনর্মুদ্রণ বা সংস্করণ প্রকাশ করেন। আবার এমন অভিযোগও আছে যে, লেখকের অনুমতি ছাড়া গ্রন্থস্বত্ব প্রকাশকের নামে নিয়ে যান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নবীন লেখকের বেলায় এমনটি ঘটে। শিল্পের স্বার্থে প্রকাশকদের এমন হীনমানসিকতার পরিবর্তন করা সময়ের দাবি।

আমাদের প্রকাশনা শিল্পের নান্দনিকতা বেড়েছে বহু গুণ। বই প্রকাশের মান, বিষয় নির্বাচনে এসেছে বৈচিত্র্য। বইয়ের নামকরণেও আধুনিকতা এবং শিল্পমাত্রায় যোগ হয়েছে নতুন আঙ্গিক। বই বাঁধাইয়ের মান অনেক উন্নত হয়েছে। প্রচ্ছদ অঙ্কনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে গত এক দশকে। তরুণ প্রচ্ছদ শিল্পীরা বিষয়-সাহিত্য এবং ভাবনা জগতের চমৎকার সমন্বয় করছেন। এখনকার প্রচ্ছদগুলোয় রঙের বৈচিত্র্যময় খেলা পাঠকদের কাছে টানছে। লেখকরা তাদের লেখায় সময়কে ধরে রাখার এবং সময়ের সঙ্গে চলার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তরুণ-উদীয়মান লেখকরা তাদের সাহিত্য রচনায় প্রযুক্তির অগ্রগতিকে যোগসূত্র হিসেবে নতুন নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করছেন। তরুণ প্রকাশকের সংখ্যা বাড়ছে। চিন্তায়-চেতনায় তরুণ প্রকাশকরা প্রকাশনা শিল্পকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। সর্বোপরি শিল্পের নান্দনিকতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রকাশনা শিল্প।

প্রকাশকরা নিজেদের বিনিয়োগে বই প্রকাশ করেন। তাদের মাথায় রাখতে হয় দেশের ক্রেতা-পাঠকের আর্থিক সামর্থ্যরে বিষয়টি। তার পরও বলব, আমাদের দেশে শিশুদের উপযোগী মানসম্পন্ন বই খুব বেশি প্রকাশিত হচ্ছে না। শিশুতোষ প্রকাশনাগুলোর বিষয় নির্বাচন, মান, লেখার দৈর্ঘ্য, অলঙ্করণ, কালার প্রভৃতি বিষয়ে প্রকাশনা শিল্পের মনোযোগ কম লক্ষণীয়। ডোরেমন, পকিমনের ছবি দিয়ে যেসব বই প্রকাশিত হতে দেখা গেছে, সেগুলোয় কাটপিসের প্রমাণ যেন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কেন জানি না, আমাদের দেশে শিশুতোষ বইগুলো তেমন চাকচিক্য হয় না। শিশুতোষ বই হওয়া উচিত উন্নত কাগজের রঙিন অঙ্কনচিত্রসংবলিত চকচকা রংময়। প্রকাশের খরচ বেড়ে যাওয়াটা অবশ্য এ ক্ষেত্রে একটা বড় বিষয়। তবু ব্যাপারটি নিয়ে আরো ভাবতে হবে। প্রজন্মের মেধা, মননশীলতা বিকাশের জন্য সুন্দর সুন্দর বৈচিত্র্যময় বিষয়ে তথ্যমূলক, ছবিসমৃদ্ধ কালারফুল ঝকঝকে বই প্রকাশ করা উচিত।

প্রকাশনা শিল্পের ভিত্তিভূমি এই বাংলাবাজার। এখান থেকেই এত এত সুন্দর, সৃজনশীল, ঐতিহ্যবাহী, নান্দনিক বই প্রকাশ এবং বাজারজাত করা হয়। কিন্তু এই বাংলাবাজারের পরিবেশ, অবকাঠামো এত অসুন্দর যে, দুটি বিষয়কে পরস্পরবিরোধী মনে হয়। বাংলাবাজারে সিংহভাগ প্রকাশনা সংস্থার অফিস ও বিক্রয় কেন্দ্র। সেখানে প্রকাশক ছাড়া অন্য যারা কাজ করেন তাদের অনেক ক্ষেত্রেই বেমানান মনে হয়। ব্যবহার, সৌজন্যবোধ, শিষ্টাচার এসব কিছু এই সৃজনশীল অফিসগুলোর অনেক জায়গায়ই নেই। একটি সমৃদ্ধ সৃজনশীল জায়গার মানুষ সুন্দর হওয়া কাম্য নয় কি?

সরকারের বিবেচনায় আনা উচিত যে, আমাদের দেশে সৃজনশীল ও অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাবাজার। এই বাংলাবাজারে ৫০ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান। সারা দেশে প্রকাশনা শিল্পে জড়িত জনশক্তি ৫ লাখের বেশি। ৬০ বছর ধরে সদরঘাটসংলগ্ন বাংলাবাজারে বাংলা বইয়ের প্রকাশনা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। এই বাংলাবাজারে ২ হাজারের বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং ৪ হাজারের বেশি বই বিক্রির দোকান রয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে পাইকারি পুস্তক বিক্রেতার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি এবং খুচরা ১৫ হাজারের বেশি পুস্তক বিক্রেতা রয়েছেন। শুধু এরা নন, প্রকাশনায় জড়িত লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, প্রুফরিডার, কম্পোজিটর এবং ডিজাইনার; যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চলছে এই প্রকাশনার বৃহৎ কার্যক্রম। সারা দেশে পাওয়া যাচ্ছে বই। অথচ এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। নেই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রকাশনা,মুক্তমত,সংস্কৃতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close