ড. আহমেদ মাওলা

  ০৭ মার্চ, ২০২১

৭ মার্চের ভাষণ ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ

বাঙালি জাতীয়তাবাদ এ দেশের সাধারণ মানুষের নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাগ্রত ঐক্যের এক অভিন্ন জীবমন্ত্র। ব্রিটিশ উপনিবেশের ২০০ বছরের শাসন এবং উনিশশ সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কলোনিপ্রতিম পূর্ববাংলার দলিত, দমিত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের গণভিত্তিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান রাজনৈতিক নেতা ও মুখ্য চরিত্র করে তোলে। দেশের সার্বিক বাস্তবতা, গণমানুষের চেতনা, প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস, সময়োচিত জনগণের পালস? বোঝার ক্যারিশম্যাটিক গুণই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু কেবল যুগের সৃষ্টি নয়, বাঙালির জাতির পাললিক স্রষ্টা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কেবল মুখনিঃসৃত শব্দরাজি নয়, প্রবঞ্চিত বাঙালি জাতির হাজার বছরের চাপা পড়া কষ্টস্বর একসঙ্গে ধ্বনিত হয়েছে। এই ভাষণ পাকিস্তানি অন্যায়, অপশাসনের বিরুদ্ধে বজ্রবৃষ্টির মতো তীব্রভাবে অভিঘাত করেছে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীকে আর বাঙালিকে দিয়েছে পথের দিশা, যুদ্ধে যাওয়ার অমিত সাহসী প্রেরণা। তাই ৭ মার্চের ভাষণের বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। কেউ কেউ এই ভাষণকে আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ (১৮৬৩) এবং মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ (১৯৬৩) ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই তুলনা যথার্থ বলে আমি মনে করি না। কারণ দুটি ভাষণেরই প্রেক্ষাপট আলাদা। বঙ্গবন্ধু এবং তৎকালীন পূর্ববাংলার আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বঞ্চনাজনিত গণবিস্ফোরণোন্মুখ। জন প্রত্যাশার চাপ এবং শত্রুপক্ষের মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে বিপুল জনতার সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে হয়েছে। সাত কোটি মানুষের সংঘবদ্ধ শক্তি এবং সংগ্রামী সাহসে আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়েই বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দিয়েছিলেন। কোনো লিখিত বক্তব্য নয়, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ এবং কাক্সিক্ষত স্বপ্নকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই অব্যর্থ, যেকোনো মারণাস্ত্রের চেয়েও অধিক শক্তিশালী।

ভাষণে উচ্চারিত শব্দমালা ও বাক্যের তাৎপর্য : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল ১৯ মিনিটের। সময়ের পরিমাপে এটি খুব স্বল্প কিন্তু তাৎপর্য অনুসন্ধান করলে বাঙালি জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ, অসামান্য এক সুবর্ণ মুহূর্ত। জনতার সঙ্গে সরাসরি ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ বলা যায়। ১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছেন ১১০৯টি শব্দ, ৮৯টি বাক্য। ‘ভায়েরা আমার’ সম্বোধন করেছে দুবার। ‘আমি’ শব্দটি সাতবার, ‘আমার’ শব্দটি ১৪ বার, ‘সংগ্রাম’ শব্দটি পাঁচবার, ‘মুক্তি’ শব্দটি দুবার, ‘মুক্ত’ শব্দটি একবার, তারপর উচ্চারণ করেছেন বহুল কাক্সিক্ষত শব্দ ‘স্বাধীনতা’ একবার এবং সর্বশেষ ‘জয় বাংলা’ বলে ভাষণ সমাপ্ত করেছেন। শব্দ এবং বাক্যের এই পরিসংখ্যান থেকে বহুমাত্রিক তাৎপর্য অনুসন্ধান করা যায়। আমরা লক্ষ করি, ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ১৬ বার এবং ‘আমাদের’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ১১ বার, এটা থেকে বোঝা যায়, তিনি সামষ্টিক চেতনাকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রকৃত নেতা কখনো সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেন না। গণভিত্তি ও জনসমর্থনই বঙ্গবন্ধুকে অসীম উচ্চতায় উপনীত করেছে, অন্য কিছু নয়। তিনি ‘সংগ্রাম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন পাঁচবার। গাণিতিক হিসেবে ৫ অড বা অবিভাজ্য নাম্বার। চর্যাপদের কাহ্নপার একটি পদ- ‘কা-আ’ তরুবর পঞ্চবি ডাল/চঞ্চল চিত্র পৈঠা কাল’ এদেহ যেন একটা বৃক্ষ, পাঁচটি তার শাখা/অস্থির চিত্তে সময় প্রবেশ করছে’ তৎকালীন পূর্ববাংলা পাকিস্তান উপনিবেশিত রাষ্ট্রে বাঙালির পঞ্চ ইন্দ্রিয় ছিল যন্ত্রণাদগ্ধ, শোষণ-নির্যাতনে পর্যুদস্ত। ‘সংগ্রাম’ শব্দটি পাঁচবার উচ্চারণ করার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যন্ত্রণাকে ইঙ্গিত করেছেন, ‘মুক্ত’ শব্দটি একবার এবং ‘মুক্তি’ শব্দটি দুবার ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু মূলত শোষণ-নির্যাতন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ভাষণের উপান্তের বাক্যটি উল্লেখ করতেই হয় ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অর্থাৎ এই পথেই ‘স্বাধীনতা’। চূড়ান্ত বিজয়। তাই উচ্চারণ করেছেন ‘জয় বাংলা’। বাংলার জয় হয়েছে, হানাদার অপশক্তি পরাজিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বীজমন্ত্র বলে। অন্য কোনো শক্তিতে নয়, মনোবল, দেহবল, সংঘবদ্ধ শক্তি আর গভীর দেশপ্রেমই ৭ মার্চের ভাষণের জাদুকরী শক্তি।

বাক্য ও বক্তব্য : নেতৃত্ব, দায়িত্ব, অভিভাবকত্ব কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, ভাইয়েরা আমার, আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনে, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরিব, দুঃখী, নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে, আমার গরিবের ওপর, আমার বাংলার মানুষের, আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, আমার লোককে হত্যা করা হয়।’

বাক্যগুলোর অন্তর্নিহিত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, বঙ্গবন্ধু ‘আমার’ শব্দটি বাঙালি জাতির পক্ষে অভিভাবকত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে, নেতৃত্বের কর্তব্য থেকে উচ্চারণ করেছেন। ‘আমার’ শব্দটি তখন ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝাচ্ছে না। মিন করছেন সামষ্টিক অর্থাৎ পুরো জাতির অর্থে। এটাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের আদর্শিক স্বাতন্ত্র্য।

‘কী অন্যায় করেছিলাম? কী পেলাম আমরা?’ এসব প্রশ্ন করে তিনি বাঙালির প্রবঞ্চনার দিকগুলোকে এনে বলেছেন, ‘সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এখানে ‘দাবায়ে’ শব্দটি ফরিদপুরের আঞ্চলিক শব্দ হলেও এর অর্থ ‘দমন’ বা ‘পশ্চাৎপদ’ করে রাখা। ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ অর্থাৎ অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না। এরপর সেই অমোঘ বাক্যটি উচ্চারণ করেছেন ‘বাংলার ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ ৭ মার্চে জনগণের প্রবল চাপ এবং প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধু যেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জনগণের মনের আকাঙ্ক্ষা তাই অত্যন্ত বিচক্ষণতা দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চারটি দাবির কথা ভাষণে উল্লেখ করেন।

‘আমার দাবি মানতে হবে ১. সামরিক আইন মার্শাল ’ল উইড্র করতে হবে। ২. সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে। ৩. যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। ৪. জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ এই দাবিগুলোকে আসলে একজন সুদক্ষ সেনানায়কের রণকৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এসব শর্তের একটা যৌক্তিকতাও রয়েছে। সেটা হচ্ছে বহির্বিশ্বকে এই ধারণা দেওয়া যে, এই আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়। এই আন্দোলনের গণভিত্তি এবং জনসমর্থন রয়েছে। তাই সেই দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত প্রায় দশ লাখ লোকের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সেই অমোঘ বাণীটি উচ্চারণ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটাই ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা। পাক হানাদার গোষ্ঠী ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে সেই চারটি শর্ত ভঙ্গ করেছিল। তাই ২৬ মার্চ স্বাধীনতার নতুন ঘোষণা আসে এবং কার্যকর হয়। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্ব তাই অপরিসীম, তাৎপর্য বহুমাত্রিক।

লেখক : অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
৭ মার্চের ভাষণ,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close