ইমাম গাজ্জালী

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২১

ফিরে দেখা ঐতিহাসিক সলঙ্গা

বিট্রিশ ভারতের বড় সময়জুড়ে কলকাতা ছিল রাজধানী। রাজনীতি সংস্কৃতি সাহিত্য সব ক্ষেত্রেই ছিল বাঙালিদের প্রভাব। তাদের অগ্রগামী অবস্থান দেখে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন, বাঙালি আজ যা ভাবে, ভারত তা ভাবে আগামীকাল। সেই বাংলার যেকোনো বড় ঘটনা কংগ্রেসের অবাঙালি নেতৃত্ব যে যথাযথ আমলে নেবেন, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন অনেকে। কারণ ১৯১৯ সালের ২৪ এপ্রিল ভারতের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার মতোই তদানীন্তন পূর্ববাংলায় সংঘটিত আরেকটি নৃশংস, ভয়ানক ও নিষ্ঠুর ঘটনা ইতিহাসে চাপা পড়ে আছে। যেভাবে উঠে আসা দরকার ছিল, মোটেই সেভাবে ঘটনাটি উঠে আসেনি। জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার মাত্র তিন বছর পর সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ।

আজ বুধবার (২৭ জানুয়ারি) ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবস। সামনের বছরেই দিবসটির শতবর্ষপূর্ণ হবে। দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হওয়ার তেমন কোনো আয়োজন নেই।সলঙ্গা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশ ভারত ছাড়ার মাত্র ২৭ বছর আগে, ভারতজুড়ে যখন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। তুরস্কের একটি ঘটনা নিয়ে মুসলিমরা সংগঠিত হয়েছিল খেলাফত আন্দোলনের ছায়াতলে। গান্ধী একপর্যায়ে খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দেন। এতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলনের সুর বেজে ওঠে। মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মুখতার আহমেদ আনসারি, হাকিম আজমল খান, আব্বাস তৈয়েবজি, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী প্রমুখ মুসলিম নেতা গান্ধীকে সমর্থন করেন। তেজি হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনের সময়কে ‘গান্ধী যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাকেও অনেকে গান্ধী যুগে ফেলেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাওলাট আইন পাস হলে ভারতের ভাইসরয় ও ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল এ আইন বলবৎ করে। এ আইনবলে ভারতবাসীর ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়; ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়। ন্যূনতম প্রমাণ দাখিল ব্যতিরেকেই সেনা ও পুলিশকে সাধারণ ভারতীয়দের গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়। গান্ধী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা করেন। সব অফিস ও কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয়দের সরকারি স্কুল, পুলিশ বিভাগ, সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরি ত্যাগে উৎসাহিত করা হয়। আইনজ্ঞরা সরকারি আদালত বর্জন করেন। গণপরিবহন, ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত কাপড় বর্জিত হয়। এ সময় আরো দু-একটি ঘটনা পরিস্থিতিতে আরো জটিল করে তোলে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একতরফা ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এরই মধ্যে তুরস্কের মোস্তফা কামাল ইসলামের খলিফা বলে পরিচিত তুরস্কের সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করলে ব্রিটিশ সরকার কামালকে সমর্থন করে। তখন লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমান সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। মুসলমান নেতারা খিলাফত কমিটি গঠন করেন। সেখানেই সমর্থন দেন গান্ধী।তখনই ভারতজুড়ে আন্দোলনের নতুন জোয়ার আসে, সেখান থেকে বাদ যায় না প্রত্যন্ত সিরাজগঞ্জ। অসহযোগ আন্দোলনে লাখ লাখ ভারতীয়ের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। ১৯১৯ সালের ২৪ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে তিন শতাধিক ভারতীয় হত্যাকান্ড, ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারিতে সলঙ্গাতে পুলিশের গুলিতে ঘটে ৫ সহস্রাধিক হতাহতের ঘটনা, তার তিন দিন আগে সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা হাটে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। চান্দাইকোনাতে আন্দোলনকারীরা পুলিশের বন্দুক কেড়ে নিয়ে পাশের ফুলজোর নদীতে ফেলে দেয়।

১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর ভারতের গোরক্ষপুর জেলায় চৌরিচৌরার ‘অসহযোগ’ আন্দোলনকারী জনতা একটি থানায় আগুন ধরিয়ে দিলে পুলিশ গুলি চালায়। সেখানে ২৩ জন পুলিশ ও তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। ‘অহিংস ও অসহযোগ’ চরিত্র থেকে আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আন্দোলনের তেজ দেখে ভীত হয়ে পড়েন। তিনি ভারতীয় জনগণকে সংগ্রাম বন্ধ করার অনুরোধ জানান। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য গান্ধী তিন দিন অনশন পালন করেন। চৌরিচৌরায় সহিংস ঘটনার ৮ দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। হিন্দু-মুসলমানের মিলন বিরোধে রূপ নেয়। ওই আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল, সেটা অব্যাহত রাখলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

আজ থেকে ৯৯ বছর আগে, ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারিতে ভারতের পাঞ্জাবের জালিনওয়ালাবাগের মতোই এক নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়। দিনটি ছিল শুক্রবার, বড় হাটবার। বিলেতি পণ্য বর্জনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফতের কর্মীরা। সেদিন ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলকারীদের ওপর বিনা উসকানিতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই চার সহস্রাধিক লোক হতাহত হয়। সলঙ্গার হাটে সংঘটিত এই পৈশাচিক হত্যাকান্ড ইতিহাসে সলঙ্গা বিদ্রোহ নামে খ্যাত। সিরাজগঞ্জের গাড়াদহ নদীর তীরেই বসত সলঙ্গার হাট। সিরাজগঞ্জ তো বটেই, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও বগুড়া থেকে নানা পণ্যবাহী মহাজনী নৌকা এসে ভিড়ত সলঙ্গার হাটে। এত নৌকা আসত যে, নদীর ঘাট প্রায় দেড় মাইল লম্বা হয়ে যেত। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করতেন, ওই হাটে লাখো লোকের সমাগম ঘটত।সলঙ্গায় সেদিনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেসময়ের তরুণ কংগ্রেসকর্মী আবদুর রশিদ, যিনি পরে আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ নামেই খ্যাতি পেয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং গণ-আজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছিলেন। এত বড় রক্তক্ষয়ী ঘটনার পরও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আসেননি সলঙ্গায়। তিনি কী এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন, জানা নেই। জনতার জাগরণ দেখে সে যুগে শুধু ইংরেজ নয়, হিন্দু মুসলিম নেতৃত্বও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। অসহযোগ ও খেলাফতের যুগ্ম আন্দোলনের ব্যর্থতা দেশীয় হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলনে ছেদ ঘটে। দুই সম্প্রদায় পুনরায় ফিরে যায় বিভেদের পথে। ফলাফল, তরুণ কংগ্রেসকর্মী আবদুর রশিদ তৎকালীন ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দেওবন্দের পথে পা বাড়ান। এই আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে, ১৯৪৭ সালের বহু আগেই তা ব্রিটিশ শাসনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে সক্ষম হতো। গান্ধীবাদী সমঝোতা ছাড়াই উদিত হতে পারত ভারতের স্বাধীনতার সূর্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পিডিএসও/এসএম শামীম

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ফিরে দেখা,ঐতিহাসিক,সলঙ্গা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close