রেজাউল করিম খোকন
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন আজও গুরুত্বপূর্ণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি শুধু, সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে রেখে গেছেন অনন্য, অতুলনীয় অর্থনৈতিক দর্শন। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া নতুন সংবিধানে দারিদ্র্য মুক্তির চমৎকার পথনির্দেশনা দিয়েছেন। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ব্যক্ত করেছেন প্রতিশ্রুতি। গরিব-দুঃখী সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ গ্রামের পরিশ্রমী কৃষক যারা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে অনেক খেটে ফসল ফলান তাদের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ছিলেন নির্ভীক। আজ এত বছর পরও বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনকে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তার চিন্তা-চেতনায় এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং স্বয়ম্ভরতা অর্জন ছিল মূল কেন্দ্রবিন্দু। অবহেলিত ভাগ্যবিড়ম্বিত নিপীড়িত, বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে তিনি সেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে শুরুতে কারো কারো মনে সংশয়, শঙ্কা, সন্দেহ দেখা দিলেও একটি পর্যায়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হতে শুরু করল এবং দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির প্রকাশ ঘটাতে শুরু করল তখন সবাই এ অসাধারণ মহান নেতার বিজ্ঞোচিত অর্থনৈতিক দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কাঠামোতে যে বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তাহলো জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বোচ্চ জনকল্যাণ নিশ্চিত করা। যা আজকের সময়ের প্রেক্ষাপটে উন্নয়নশীল দেশের অভিযাত্রায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু যে ধারণাটি পোষণ করতেন তাহলো, দেশের মানুষ যদি হতদরিদ্র থাকে তবে দেশও হতদরিদ্র থাকবে। কাজেই মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে যখন মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলা যাবে তখন দেশও সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধু তার অর্থনীতির ধারণায় সম্পদের সুষম বণ্টন ও সম্পদ সৃষ্টির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ দুটি উপাদানই মানবিক উন্নয়নের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দারিদ্র্য দূরীকরণের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এই মানুষটি। ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার, শিল্প বিকাশের নতুন নতুন উদ্যোগ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান, কৃষির আধুনিকায়নে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ, সমবায় চেতনা বিকাশে শুরু করেছিলেন নানা কর্মযজ্ঞ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সমাজের সব মানুষের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়া, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, নারী জাগরণ ও ক্ষমতায়ন কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে সবসময় বঙ্গবন্ধুর ভাবনাজুড়ে ছিল সাধারণ জনগণ। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে তিনি গ্রহণ করেছিলেন যুগান্তকারী নানা পদক্ষেপ।
জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সামাজিক সূচকে আমাদের কেমন অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, বিশ্বমানের মানবসম্পদ কীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব তার সবই রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক দর্শনে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দারিদ্র্য মুক্তির লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনা শুধু বাংলাদেশেই প্রাসঙ্গিক তা নয়, পিছিয়ে পড়া অন্য জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য হতে পারে পথনির্দেশিকা। আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার সোপান হিসেবে জাতীয় বাজেট প্রণয়নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মোটেও কার্পণ্য করেননি বঙ্গবন্ধু। সদ্য স্বাধীন দেশের বাজেটে তখন সেই চিত্রটিই ফুটে উঠেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্বাসনের পাশাপাশি নতুন অবকাঠামো তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞ এবং সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটে তৎকালীন সরকারি নানা কর্মসূচিতে।
পাকিস্তানিদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কঠিন দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিলেন। সব জটিল চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সুনিপুুণভাবে। এই সময় তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের সব নীতি ছিল দেশের মানুষের স্বার্থকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশাসনকে পরিচালিত করতে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কাছে সবকিছুর আগে ছিল দেশের স্বার্থ। তার ব্যক্তিত্বের অসাধারণত্ব আজো বিরল, বলা চলে। তার দৃঢ়চেতা মনোভাব এবং জাদুকরী সম্মোহনী শক্তি যে কোনো কঠিন বাধা দূর করতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখত। তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল বেশ কিছু অসাধারণ সাফল্য। স্বাধীনতার পর গৃহীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ করা হয়। এই সময়ের প্রণীত বাজেটগুলোতে কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ থেকে প্রতীয়মান হয় বঙ্গবন্ধু সরকার কৃষি ও শিল্প উভয় খাতেই প্রায় সমান গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে উন্নয়নের সোপানে উন্নীত করতে এ খাত দুটিকেই গুরুত্বারোপ করাই ছিল জাতীয় উন্নয়ন নীতি। এই জাতীয় নীতির বাস্তবায়নে সরকার শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ এবং ভূমির মালিকানায় কৃষকের স্বত্বসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করার ও কৃষির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তখনো বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ছিল না। তাই দেশীয় সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। দেশীয় পণ্য উৎপাদন করে নিজস্ব চাহিদা পূরণ ও রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন যদিও তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়, তবুও বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বিদেশি ঋণনির্ভর না হয়ে একটি সফল শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেই যেসব অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হলো কৃষি খাতের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন। জনমানুষের কল্যাণ কামনায় সদা নিবেদিতপ্রাণ বঙ্গবন্ধু বাংলার কৃষকের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করতেন। রাজনীতির প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত এলাকায় বহু জায়গায় গেছেন। পেয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম প্রীতি, হৃদয় নিংড়ানো স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। এই উভয় দিকের পারস্পরিক ভালোবাসার নিখাদ ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বকে আজীবন মনে রেখেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রামবাংলায় বাস করতেন। জাতীয় আয়ের অর্ধেকেরও বেশ আহরিত হতো কৃষি খাত থেকে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অমানুষিক পরিশ্রম করে যে কৃষক দেশের সব মানুষের অন্নের জোগান দিচ্ছেন, সে কথা কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করতেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কিছু মধ্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল প্রথমত, স্বনির্ভরতা, যতটা সম্ভব দেশের সম্পদ ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, বিদেশ ও দাতাদের কাছ থেকে শর্তহীন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে স্বাগত জানানো এবং ক্রমান্বয়ে এ ধরনের নির্ভরতা হ্রাস করা। তৃতীয়ত, ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সীমা ২৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয়। কাজেই বেসরকারি খাতকে বঙ্গবন্ধু উপেক্ষা করেছেন, এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও দুর্নীতি হ্রাস, উন্নয়নের জন্য সম্পদ সংগ্রহ। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের মূল কথা।
১৯৭৫ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছিল। কারণ বাংলাদেশ যে সাহায্য পেয়েছিল বিভিন্ন দেশ থেকে তার সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিল। জনগণ সক্রিয় ছিল, একটি স্বাধীন দেশ ও এর উন্নতির দিকে আগ্রহ নিয়ে সবাই অপেক্ষায় ছিল। কৃষি উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ছিল, বৈদেশিক সাহায্যের সঠিক ব্যবহার বাড়ছিল, মূল্যস্ফীতি কমে আসছিল। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম হিসেবে সমাজতন্ত্রকে যুক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার ঘোষিত সমাজতন্ত্রের রূপটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনের সমাজতন্ত্রের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে নিয়েছিলেন বহুমুখী পরিকল্পনা, দিয়েছিলেন অর্থনীতির নতুন ফর্মুলা। তারই উদ্ভাবিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শন বাস্তবে রূপ দিতে অন্যতম মৌল উপাদান হিসেবে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তার দর্শন মতে, দেশে দারিদ্র্য বলে কোনো শব্দ থাকবে না। প্রতিটি মানুষ আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এখানে কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না। কেউ কাউকে শোষণ করবে না। বঞ্চিত করবে না তার প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার থেকে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লগ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের মুহূর্তে দেশ ও জাতি তার অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক চিন্তাধারার সুদূরপ্রসারী ফলাফল ভোগ করছে বিভিন্নভাবে। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। অনুন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের সারিতে নিজের অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার নির্দেশিত পথ ধরে সমৃদ্ধি ও সাফল্যের নানা সোপান অতিক্রম করে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে গণ্য হচ্ছে বিশ্বের দরবারে। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন এখনো বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কোনোভাবেই অপ্রাসঙ্গিক কিংবা অপ্রয়োজনীয় নয়। বরং তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নির্দ্বিধায় বলা যায়। শুধু এ দেশের জন্যই নয় বিশ্বের যে কোনো দেশেই তার অর্থনৈতিক দর্শন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে ভীষণভাবে প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
পিডিএসও/ জিজাক