১৩ অক্টোবর, ২০২০

ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মোড় অন্যদিকে

দেশব্যাপী নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ মানুষ। সারাদেশে বইছে প্রতিবাদের ঝড়। নারী নির্যাতনকারীদের গ্রেফতার এবং কঠোর শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু গত কয়েক দিনে লক্ষ করা গেছে, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীদের মাঝে ঢুকে পড়েছে সরকারবিরোধী একটি চক্র। যারা সব সময়ই থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। যদিও তাদের এই কুচিন্তা কখনোই সফলতার মুখ দেখবে না। তবে সরকারের জন্য এটি ভালো কিছু নয়।

আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল রাজধানী ঢাকার শাহবাগ এলাকা। যেখানে প্রতিদিন ধর্ষণবিরোধী মিছিল, বক্তব্য, গান, কবিতা ও স্লোগানে মুখরিত থাকে। এখানে আন্দোলনকারীদের সিংহভাগই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও অনেকে এসে যোগ দেন শাহবাগের সমাবেশে। তাদের হাতে থাকে হরেক রকম স্লোগান সংবলিত প্লেকার্ড। কিন্তু সেই সমাবেশেই দেখা গেছে, ধর্ষণের বিচার না চেয়ে সরকারবিরোধী প্লেকার্ড ও স্লোগান দিচ্ছে আন্দোলনকারীদের একাংশ। ইতোমধ্যে অনেকেই বলেছেন, ধর্ষকের প্রশ্রয়দাতারা এখন গুজব তৈরিতে ব্যস্ত, তারা আসমানি আশাকে নাতাশা বানিয়ে ফেলছেন। আর গুজব তৈরি করে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নোংরা অপচেষ্টা করছেন। কিন্তু এমনটি কেন? আমাদের মনে রাখা উচিত, সব সময় কলা বিক্রির পাশাপাশি রথ দেখা যায় না। নোয়াখালীর নারী নির্যাতনসহ এসব ঘটনায় সম্পৃক্ত পৃষ্ঠপোষকদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার এবং নারীর প্রতি সহিংসতার স্থায়ী অবসানের দাবিতে যে আন্দোলন অব্যাহত আছে, সেই আন্দোলনের মোড় অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় প্রশাসনের শত চেষ্টার পরও প্রকৃত ধর্ষণকারীরা আড়ালে রয়ে যাবে।

এদিকে সম্প্রতি আন্দোলনের যেসব ছবি বা ভিডিও গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে তার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়। যে ছবিতে দেখা গেছে, একজন মেয়ে দুই হাতে একটি প্লেকার্ড ধরে আছে। যেখানে শেখ হাসিনার পতন চেয়ে একটি আপত্তিকর স্লোগান লেখা রয়েছে। সত্যি বলতে কী, হীনম্মন্যতারও একটি সীমা থাকা উচিত। কেননা একজন শিক্ষিত নারী কখনোই এমন শব্দসংবলিত প্লেকার্ড বহন করতে পারেন না। যদিও ওই তরুণীর প্লেকার্ডের লেখা নিয়ে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। তবে অনেকেই বলছেন, বরাবরের মতো এবারের আন্দোলনকেও বিনষ্ট ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে একশ্রেণির মানুষ বসে আছে কম্পিউটারের সামনে। যাদের কাজ হলো, সত্য ছবি ও লেখাকে পরিবর্তন করে সমালোচনা তৈরি হবে, এমন লেখা এবং ছবি বানিয়ে তা প্রচার করা, গুজব সৃষ্টি করা। যা সমাজ, জাতি, সরকার ও দেশের জন্য খুবই ভয়ংকর। আর তাই গুজব সৃষ্টিকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে সমালোচনার মুখে পড়বে সরকার।

আমরা জানি, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ভাবিয়ে তুলছে জাতিকে। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে ধর্ষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কোনো নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হলে, অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের পাশাপাশি উন্নত মূল্যবোধের চর্চায় গুরুত্ব বাড়াতে হবে। অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি নৈতিকতার চর্চা ও সামাজিক আন্দোলন নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সহায়ক হবে।

ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হচ্ছে। কিন্তু এতে হয়তো অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো ধর্ষণ কমলেও নির্মূল হবে না। আর ধর্ষণ নির্মূল করতে এ মুহূর্তে প্রয়োজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দরকার নারীর ওপর পূর্ণবিশ্বাস স্থাপন এবং অহেতুক সভ্যতাবিরোধী মৌলবাদের মতো নারীর পোশাকের ওপর দোষ না চাপানো। এ ছাড়াও ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে বস্তাবন্দি করার যে আয়োজন চলছে, অন্যদিকে পুরুষের কৌতূহল আরো বাড়ছে নারীর দেহ নিয়ে। পুরুষের সংযম সাধনার কোনো নৈতিক শিক্ষা না থাকলে শুধু নারীর পোশাকের দোষ দিলে দিনে দিনে হায়েনার তান্ডব চলতেই থাকবে।

বর্তমান সময়ে নারীদের চোখে-মুখে ভয়, আতঙ্ক। তাদের শঙ্কা নিজের নিরাপত্তা নিয়ে। এই সমাজে নারীরা নিরাপদ কোথায়? স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন নারী। নিজের বাড়িতে লাঞ্ছিত হয়েছেন নারী। চার বছরের শিশুকেও ছাড়ছে না ধর্ষকরা। বাবার কাছেও নেই মেয়ের নিরাপত্তা! একের পর এক ধর্ষণ-গণধর্ষণ!

আমাদের মনে রাখা উচিত, ধর্ষক কেবলই ধর্ষক। মানসিক বিকারগ্রস্ত, ড্রাগ এডিক্ট, পর্নো এডিক্ট হায়েনাদের এসব পরিচয় দিয়ে বর্বরতার জঘন্যতাকে আড়াল করা হয়। পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়, এ কথাটা কেউ ধর্ষকের ক্ষেত্রে বললে যেমন মাথায় রক্ত উঠে যাবে; তেমনি ধর্ষকের দলীয় পরিচয় নিয়ে যারা দলকে বা একটি গোষ্ঠীকে খাটো করতে উঠেপড়ে লাগে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।

পরিশেষে বলব, আসুন আগে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাই। নারীরা মা, নারীরা মেয়ে, নারীরা বোন, নারীরা সহধর্মিণী। তাই নারীকে মানুষের চোখে দেখি, হায়েনার চোখে নয়। তবেই নারীরা পাবেন নিশ্চিত নিরাপত্তা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধর্ষণবিরোধী,আন্দোলন,এসএম শামীম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close