এম এ মাসুদ

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ডানের গরু মোচড় খায়

আমরা যান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করেছি। কৃষি জমি চাষেও চলছে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর দিয়ে কর্ষণ। গরু, মহিষ দিয়ে হালচাষ এখন আর তেমনটি চোখে পড়েনা। তাই এখনকার প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো 'ডানের গরু মোচড় খায়' বাক্যটি বেশ অদ্ভুত বা বিদঘুটে মনে হবে বৈকি! কিন্তু আমরা যারা গরু, মহিষ দিয়ে হালচাষ করা দেখেছি তাদের কাছে 'মোচড়' শব্দটি অতি পরিচিত। মোচড়, মোচড়ানো বা মটকানো এ শব্দগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ শব্দগুলোর ইংরেজি প্রতিশব্দ Twist, Wringev Screw.

যদিওবা অনেকেই আমরা হালচাষ কখনো করিনি, তবুও যাদের বয়স দু'দশকের কাছাকাছি বা তার একটু অধিক তারা কম-বেশি সকলেই জানি, হালচাষ করতে গেলে দু'টো গরু বা মহিষের প্রয়োজন হয়। আবার এটাও নিশ্চয়ই জানা আছে, দু'টো গরু বা মহিষের বামেরটির শক্তি কম হলেও চলে, কিন্তু ডানেরটির শক্তি বা সামর্থ একটু বেশিই লাগে। চাষী যখন হালচাষ করেন, তখন জমির শেষ প্রান্তে ঘোরার সময় প্রতিবারই ওই ডানের সবল গরুটির লেজ ধরেই একটা 'মোচড় বা মটকা' বা হাতে থাকা লাঠি (পেন্টি) দিয়ে সজোরে পিঠে একটি মার (আঘাত) দেন। এতে বামের গরুটি প্রায় স্থির থাকলেও ডানেরটি দ্রুত কয়েক মিটার দূর দিয়ে ঘুরে আসে। শক্তি বা সামর্থবান ও হালচাষ-মইয়ে পারদর্শী হওয়া সত্বেও ডানেরটির ওপর চাপ বেশি। এভাবে লেজে মোচড় আর পিঠে মারডাঙ খেয়েই চলতে থাকে তার সবল জীবন। পক্ষান্তরে, হালচাষ ও মইয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বলটির উপর যেমন চাপ নেই, তেমনি মোচড় বা মারও খাওয়ার ভয়ও নেই তার।

হালচাষ ও মইয়ের ডান-বাম আর মটকা খাওয়ার খেলার সাথে মানবজীবনের সাদৃশ্যও কেনো জানি কাকতালীয়ভাবে মিলে যায়। আর সেটিই আমার লেখার বিষয়।

ছোট বেলায় যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন দেখেছি, যে ভাল ছাত্র বা ছাত্রী ছিল তাকে স্যার লাগিয়ে দিতেন ধারাপাত পড়াতে। সে আগে জোরে জোরে পড়তো তারপর বাকি ছাত্র-ছাত্রীরা সেই সুরে সুরে পড়তো। আবার যারা লেখাপড়ায় ভালো ছিল তারাই গাইতো জাতীয় সংগীত, হইতো ওই শ্রেনির নেতা বা ক্যাপ্টেন। একদিন যদি পড়া না হত বা ধারাপাত আর জাতীয় সংগীত গাইতে ভুল হতো তাহলে জুটতো বেতের মার।

পারিবারিক জীবনেও দেখা যায়, কোনো পরিবারে পিতা-মাতার দুই বা ততোধিক সন্তান থাকলে যে ভাল তাকেই বেশি কর্ম করতে হয়। আর যে অলস প্রকৃতির সে পারিনা, পারবোনা বলেই খালাস। তার ওপর পিতা-মাতার নেই কোনো চাপ। এক সময় দেখা যায়, পিতা-মাতা ওই অলসকে সচল করতে দিয়ে দেন বাড়তি জমিজমা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

আবার, ঠিক একই চিত্রের দেখা মিলে বিভিন্ন সরকারি,বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায়ও। বেসরকারি সংস্থাগুলোতে দেখা যায়, যে ভাল পারফর্ম করবে তাকে ততো খাটতে হবে। যেতে হবে সংস্থা ভাল পারফর্ম করতে পারছেনা এমন এলাকায়। আর যিনি ওই এলাকায় ছিলেন তাকেই নিয়ে আসা হতে পারে ভাল পারফর্মকারীর এলাকায়। তবে জীবিকার তাগিদে ও জবাবদিহিতা থাকায় সময়ের ব্যবধানে এক সময় দুর্বলও সবলে পরিণত হতে বাধ্য হয় এসব সংস্থায়।

প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডান-বামের খেলার উপস্থিতি অনেকটা না থাকলেও অনেক এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক স্কুল, স্কুল এন্ড কলেজ ও সমমান মাদ্রাসায় রয়েছে 'মোচড় বা মটকা খাওয়া'র উপস্থিতি। বিশ্বাস করি, সব শিক্ষক মহোদয়ই ভাল। তবে বিশেষণের তুলনা করে বলা যায়- ভাল,তার চেয়ে ভাল, সবচেয়ে ভাল শিক্ষকও রয়েছেন। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের জন্য রয়েছেন- বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সহকারী শিক্ষক, সিনিয়র সহকারি শিক্ষক, প্রভাষক এমনকি সহকারি অধ্যাপকও। পাঠদান করতে হয় নিজের বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ও। সহকারি শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রভাষক ও সহকারি অধ্যাপকদের নিতে হয় মাধ্যমিক স্তরেও ক্লাস। দেখা যায় সহকারি শিক্ষক, প্রভাষক বা সহকারি অধ্যাপকদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে ভাল তাদের ওপর প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ চাপিয়ে দেন বিশেষ বিশেষ বিষয়ে পাঠদানের দায়িত্ব। যথেষ্ট পরিশ্রমী ওই সব শিক্ষকের ঘন্টাও নিতে হয় বেশি এবং ছুটিও ভোগ করেন কম।

ফলস্বরূপ, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশেষণের তুলনায় যারা ভাল বা তার চেয়ে ভাল তারা নিজেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করা থেকে বিরত রাখেন। বিশেষ বিশেষ বিষয়ে পাঠদান থেকে রেহাই, ঘণ্টা কমে যাওয়া ও বেশি ছুটি ভোগের সুবিধা পাওয়ায় তাদের অনেকেই তোলেন হয়তোবা পরম তৃপ্তির ঢেঁকুর ! কিন্তু তারা হয়তোবা জানেন না, যে সব ঢেঁকুরই তৃপ্তির নয়।

অধ্যবসায় যে একজন মানুষকে অসাধ্য সাধনে সহায়তা করতে পারে জগতে তার প্রমাণ রয়েছে অনেক। কথিত আছে নেপোলিয়ন বেনাপোর্ট বলতেন, “তার অভিধানে অসম্ভব বলতে কোনো শব্দ নেই।” আমার দেখা মাদ্রাসায় কর্মরত এক সহকারি শিক্ষক(কৃষি) উচ্চ মাধ্যমিকে আইসিটি বিষয়ে পাঠদান করেন এবং অধ্যবসায় গুণে এখন তিনি ওই বিষয়ের মাষ্টার ট্রেইনারও বটে।

সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রধান শিক্ষক শাহজাহান ভাইকে গল্প করতে শুনেছি। তিনি বলেন, “আমি এর আগে যখন মাদ্রাসায় সহকারি শিক্ষক হিসেবে ছিলাম, তখন একদিন ৯ম শ্রেনিতে ইংরেজিতে নেয়ার সময় পাশের ৮ম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা চেঁচামেচি করছিল। আমি গিয়ে তাদেরকে বললাম, তোমাদের কোন বিষয়ে ক্লাস আছে? তারা বললো কোরআন। শুনে আমার তো আক্কেল গুড়ুম। আমি বই নিয়ে দেখি সূরা আল ফীল পড়া। সাহস পেলাম। বই বন্ধ করে শানে নুযুলসহ পড়ালাম। গুণগত মানে শিক্ষকদের মাঝে তারতম্য থাকলেও একজন শিক্ষক যদি অধ্যবসায়ী হন, তবে কম-বেশি সব বিষয়ই জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে পাঠদান করা সম্ভব। ”

পরিশেষে বলা যায়, সবচেয়ে ভালদের প্রতি অতিরিক্ত চাপ না বাড়িয়ে ভাল ও তার চেয়ে ভালদের প্রতি যত্নবান হলে তবেই ভাল, তার চেয়ে ভালরাও একদিন সবচেয়ে ভালতে পারিণত হবে সেটিই প্রত্যাশা।

লেখক : সংবাদকর্মী

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ডানের,গরু,মোচড়,খায়
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close