সম্পাদকীয়
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দায়িত্ব নিতে হবে
মানব সম্প্রদায় যত বেশি দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়ছে, পৃথিবী তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাতাস তার গুণাবলি হারিয়ে ফেলছে। প্রাণী তার অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহামারির কবলে আজ বিপর্যস্ত এই পৃথিবী। এককথায় পৃথিবী আজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। মানুষের চরমতম ভোগবাদী দর্শনের কারণে আজকের এই বিপর্যয়। কিন্তু এ কথা সত্য যে, ‘সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না’। কেবল ধর্মীয় সূত্রই এ কথা বলছে না, বিজ্ঞানও একই মত পোষণ করে। একটি বেলুনে মাত্রাতিরিক্ত বাতাস প্রবেশ করালে বেলুনটি আর স্বাভাবিক থাকার ক্ষমতা রাখে না। ফেটে যায়। অর্থাৎ বাতাস প্রবেশের ক্ষেত্রে এখানে সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে। আর এই সীমা লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রতিনিয়তই করে চলেছে মানব সম্প্রদায়। আর সে কারণেই অনেকে বলে থাকেন, মানুষের হাতেই এক দিন পৃথিবী ধ্বংস হবে।
বন উজাড় এবং মাত্রাতিরিক্ত ভোগের কারণে গত ৫০ বছরে পৃথিবীতে বন্যপ্রাণী কমে গেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এ সময়ে ভূপৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ এবং সমুদ্রগুলোর ৪০ শতাংশই মানব সম্প্রদায়ের আগ্রাসনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গড়ে বন্যপ্রাণী কমেছে প্রায় ৬৮ শতাংশ। এর পেছনে ক্রমবর্ধমান হারে বন উজাড়কেই দায়ী করা হয়। ডব্লিউডব্লিউএফের মহাপরিচালক মার্কো লাম্বারতিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ৩০ বছর ধরে এই প্রবণতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এবং এই প্রবণতা একটি ভুল পরিক্রমণ। ২০১৬ সালে যা ৬০ শতাংশ ছিল, এখন তা ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ গ্রহে লাখ লাখ বছর ধরে বেঁচে থাকা অনেক প্রজাতির জন্য এটিকে মুহূর্তের পরিবর্তন বলে ধরে নেওয়া যায়। ক্রমাহত প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংসের কারণে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে বৈশ্বিক মহামারির ঝুঁকিটাও বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। আমরা মনে করি, কেবল মহামারি আক্রান্ত হয়ে সভ্যতা বিনষ্ট হওয়ার মাঝেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
গোটা বিশ্ব আজ ভোগবাদী সমাজে পরিণত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ তা মাত্রার সব সীমাকে লঙ্ঘন করেছে। বর্তমান পৃথিবীর যা অবস্থা, সে ক্ষেত্রে এ মুহূর্ত থেকেই লাগাম টেনে ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে যেকোনো মুহূর্তে মানব সম্প্রদায়কে এক মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। বিজ্ঞানীদের মতে, কোভিড-১৯-এর মতো যেসব রোগ বন্যপ্রাণী থেকে মানবদেহে ছড়াতে পারে, সেগুলোর প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম বড় কারণ দ্রুত বন উজাড়। প্রকৃতপক্ষে এসব রোগকে মানুষ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে বনাঞ্চল। আমরা যত বেশি তাদের ধ্বংস করব এর (রোগের) সম্ভাবনাও তত বাড়বে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী এক দশকে যদি বিশ্ব যে ধারায় চলছে তা অব্যাহত থাকে; তাহলে বন্যপ্রাণীর যে ক্ষতি হবে, তা পূরণে কয়েক দশক লেগে যাবে এবং কিছু প্রজাতি বিলুপ্তও হতে পারে। আমরা মনে করি, কেবল কিছু প্রজাতির বিলুপ্তির মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকবে না। মানব প্রজাতির ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। সুতরাং, মানব স্বার্থ সংরক্ষণের কথা চিন্তা করে বন সংরক্ষণ সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।