রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৩ জুলাই, ২০২০

করোনাকালে শিক্ষার ক্ষতি অপূরণীয়

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৬ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এর ফলে পিছিয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষাও। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা দিচ্ছে সেশনজটের আশঙ্কা। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এটা অতি পুরাতন কথা। আর বর্তমানে বলা হচ্ছে, আধুনিক তথা কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া শিক্ষা মূল্যহীন। এর সঙ্গে নৈতিকতা ও মানকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে যারা যত অগ্রগামী হচ্ছে, তারা তত উন্নতি করছে। তাই বেশির ভাগ দেশ এসবের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তবে এতে সব দেশই যে সমান সফল হয়েছে, তা নয়। তথাপিও যতটুকু উন্নতি করেছে, তাও থমকে গেছে করোনা মহামারিতে। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর এর বিশ্বায়ন হয়েছে খুব দ্রুত; যা মোকাবিলার জন্য একে একে প্রায় সব দেশ লকডাউন করেছে। ফলে সব খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বর্তমানে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস আলোচনার টেবিলে কেন্দ্রবিন্দু। এ সময় শিক্ষার্থীদের অনেক কিছু করতে হবে নিজেকে ভালো রাখার জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য। শিক্ষার্থীরাই তো দেশ ও দশের সম্পদ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হলো ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একগুচ্ছ লক্ষ্যমাত্রা। টেকসই উন্নয়নের ব্যাপারটা প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৮৭ সালে, ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের রিপোর্টে। ২০০০ সালে শুরু হওয়া ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ অর্জনের সময় শেষ হয় ২০১৫ সালে। এরপর জাতিসংঘ ঘোষণা করে ১৫ বছর মেয়াদি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল।

জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ২০১৬ থেকে ২০৩০ মেয়াদে এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ লক্ষ্য হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। করোনা-পরবর্তী সারা বিশ্বে তৈরি হবে অর্থনৈতিক মন্দা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটাই কঠিন হয়ে যেতে পারে আমাদের জন্য। সবথেকে বেশি কঠিন হয়ে যাবে শিক্ষাকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। অনলাইনে শিক্ষকরা শিক্ষাদানে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছেন, তবে আমাদের চাই সুনির্দিষ্ট দূর শিক্ষণ; যাতে আমরা সব পরিস্থিতিতে নিজেদের এগিয়ে নিতে পারি। উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘তুমি যখন সবচেয়ে বাজে মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছো; তখনো থেমো না, চলতে থাকো।’ বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে থমকে আছে পুরো বিশ্ব, আমাদের দেশ এবং নাগরিক জীবনযাত্রা। আমরা সবাই নিজেদের জীবনের বাজে মুহূর্তের মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করছি; তবে আমাদের থেমে যাওয়া যাবে না, চলতেই হবেই পথ। পথের তো শেষ আছে, সেই পথের শেষে প্রতীক্ষায় নতুন দিনের নতুন বিশ্ব, নতুন বাংলাদেশ। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, স্কুল স্টাফসহ সংশ্লিষ্ট সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার মহৎ উদ্দেশ্যে গত ১৮ মার্চ ২০২০ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রমসহ যাবতীয় কাজ বন্ধ করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে নেই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি কিংবা সবুজ মাঠে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা। শিক্ষক কমনরুমে নেই শিক্ষকদের খন্ড খন্ড আলোচনা, সর্বত্র যেন শ্মশানের নীরবতা। দিনে দিনে আরো কঠিন পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি।

সবাই তো কমবেশি জানি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কীভাবে ক্লাস করে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন ব্যবস্থা, স্যানিটেশনসহ সার্বিক কাঠামো কোন পর্যায়ের। বর্তমান যুগে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখভাল সঠিকরূপে হয় না। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক-ওদিক কাজে-অকাজে যখন যেভাবে পারছি নিয়ম না মেনেই। বিপণিবিতান কিংবা পাবলিক পরিবহনে নেই কোনো বাস্তব উদাহরণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে, এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে কি? স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে করোনা সংক্রমিত হয়েছে অধিক মাত্রায়। আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর মিছিল হচ্ছে দীর্ঘ। জীবন থেমে থাকে না, ছুটে চলে বহতা নদীর মতো। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কত দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখব? আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও নিজেদের মধ্য দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা সম্ভব নয়, তাই এখন ভরসা অনলাইন পাঠদান। সারা দেশের মতো বিভাগীয় শহর সিলেটজুড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে অনলাইনে পাঠদান করছেন এ অঞ্চলের শিক্ষকরা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে। আমাদের এ সময় থেকে শিক্ষা নিতে হবে কীভাবে দুর্যোগ কিংবা মহামারিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। এ নিয়ে গবেষণা করা সময়ের দাবি, একই সঙ্গে দূর শিক্ষণের জন্য একটি টিম চালু রাখা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; যাতে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায় কার্যকরভাবে। আসলে পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। শহরে অবশ্য এ ধরনের পরিবেশ নেই। অভিভাবকরা সচেতন।

কিন্তু শহর ও গ্রামের মধ্যে পরিবেশগত পার্থক্য থাকলেও আজকাল গ্রামের ছেলেমেয়েরাও পরীক্ষায় ভালো ফল করছে। তাই এ সংকটকালে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলতে চাই, দৃষ্টি, মনোযোগ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাও; দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। মনের শক্তি, বলে, আত্মবিশ্বাসী হও, এ সংকট কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তবে অযথা সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। একটু পরিশ্রম করো, মনোযোগী হও, পড়ার টেবিলে বসো, দেখবে মনের অসাড়তা কেটে গেছে। করোনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা যে স্থবির হয়ে পড়েছে, তা পুষিয়ে নিতে হবে শিক্ষার্থীদেরই। এর ব্যতিক্রম হলে শিক্ষার্থীরা অনেকেই বিপাকে পড়তে পারেন। সরকার তো চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। এ সংকট বাংলাদেশের একার নয়, বিশ্ব সংকট। করোনা আমাদের পরিবারের, সমাজের, সরকারের সব পরিকল্পনা থামিয়ে দিয়েছে। কোনো রোগব্যাধি মহামারি চিরস্থায়ী নয়। করোনাও এক দিন থেমে যাবে। তবে কিছু সময় লাগতে পারে। বিপুলমাত্রায় ছড়িয়ে পড়া করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে না। সিংহভাগ অভিভাবক এ সিদ্ধান্তে খুশি আছেন আবার একটা অংশ মনে করে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া গেলে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতে পারত। বাংলাদেশ শিক্ষা ও তথ্য পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬২০টি। মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০ হাজার ৬৬০টি। এরমধ্যে সরকারি ৬৭৫টি। সরকারি ও বেসরকারি মিলে দেশে কলেজের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৫১টি।

এরমধ্যে বেসরকারি কলেজের সংখ্যা ৩ হাজার ৯৯০টি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৩টি। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-মাদরাসা, পলিটেকনিক, কারিগরি ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের অগণিত শিক্ষার্থী শিক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনরাত্রির অলসকাব্য লিখে চলেছে প্রতীক্ষার প্রহর গুণে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালা কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হবে, তা নিয়ে রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। মোটকথা বিশ্বের প্রায় সব দেশের ন্যায় এ দেশেও শিক্ষার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে এক বছর নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু একটি বছর শিক্ষার্থীদের জীবনে মহামূল্যবান। একে নষ্ট করতে দেওয়া সমীচীন নয়। শিক্ষার্থীরাও তা চাইবে না। কারণ দু-এক বছরের মধ্যে বহু শিক্ষার্থীর বয়স পূর্ণ হয়ে যাবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে। তাই তাদের কাছে এই এক বছর অতি গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি বেশির ভাগ অভিভাবকের সামর্থ্য নেই অতিরিক্ত এক বছরের শিক্ষা ব্যয় বহন করার। আবার প্রাইভেট পড়ে কিংবা কোচিং করে পুষিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য নেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২-৩ মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে এবং তা ফুল কোর্সের ভিত্তিতেই। কারণ, কোর্স শর্টকাট করে কিংবা ৬ মাস ড্রপ করে বছর অতিক্রান্ত করা হলে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হবে, তা তাদের বহন করতে হবে সারা জীবন। সেসঙ্গে দেশকেও। তাই ফুল কোর্স পূরণ করতে হবে। আবার করোনা সৃষ্ট ক্ষতিও পুষিয়ে নিতে হবে। একুশ শতকের দক্ষতা, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

সময়ের সঙ্গে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের দক্ষতায় দক্ষ করে তুলতে হবে। ২১ শতকের দক্ষতাগুলো যেমনজটিল চিন্তা ও সমস্যা সমাধান, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সহযোগিতামূলক ও দলগত দক্ষতা, নৈতিকতা ও সহমর্মিতা, সক্রিয়তা নিয়ে আরো ভাবতে হবে। বর্তমানে এ দক্ষতাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামীর সম্ভাবনাগুলো নিরূপণ করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দক্ষতাগুলোকে কার্যকরী করে তুলতে হবে। এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জটিল চিন্তা করা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। শিক্ষার্থীরা এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আগামীর সময়কে খুব সহজে মোকাবিলা করতে পারবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিক্ষা,করোনাকাল,শিক্ষার্থী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close