সিমিন হোসেন রিমি

  ২২ জুলাই, ২০২০

তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারী আলোকিত একজন মানুষ। নিজ দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন তিনি জনকল্যাণে। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তার গভীর ভালবাসা তার রেখে যাওয়া প্রতিটি কাজে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

তাজউদ্দীন আহমদের ভাবনা নিজেকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজকে স্পর্শ করে। ১৯৭১ য়ে মুক্তিযুদ্ধ দিনের কঠিন কর্মযজ্ঞকে বিস্ময়কর নিপুনভাবে পরিচালনা করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়ী পতাকা জনগণের হাতে তুলে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাসের সঠিক গতিধারা থেকে তিনি কখনোই বিচ্যুত হননি।

তাজউদ্দীন আহমদ তার ছাত্র জীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে এদেশে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে তার প্রতিটিতে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগ গঠন প্রক্রিয়ার মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি একজন।

পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ৬ দফার অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজয় লাভের পর পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করলে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এই অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত জোরালো সাংগঠনিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শুরু করে একতরফা গণহত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে তারা গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় এই দেশের মানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও বাঁচার লড়াই মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের উপর। ১৯৭১ সালের সেই সংকটময় মুহুর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। মাত্র নয় মাসের মধ্যে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন লক্ষ্যে স্থির, বিশ্বাসে অটল, নির্লোভ চরিত্রের, কাজে বিশ্বাসী, আত্মপ্রচার বিমূখ অসাধারণ একজন মানুষ। তার দৃষ্টি ছিল বর্তমানকে ভেদ করে আগত সুদৃঢ় ভবিষ্যতে। তার ভাবনার ভিত্তি যুক্তি ও বাস্তবতা। তার দৃষ্টি অবারিত যেমন স্বদেশে, তেমনি বিশ্বে। তিনি ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়েছেন প্রেরণার আলোকবর্তিকায়।

তাজউদ্দীন আহমদ তার তরুণ বয়স থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সেই ডায়েরির প্রতিটি পাতা সাক্ষ্য দেয় তিনি ছিলেন প্রবলভাবে সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ। যিনি নিরলসভাবে তার প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তকে কোন না কোন কাজে নিয়োজিত করেছেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজকে উন্নত অবস্থায় পৌছে দিতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই সকল সময় সচেষ্ট থেকেছেন স্কুল গড়ে তোলাসহ স্কুলের জন্য কাজ করতে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সমাজ গঠনের বিষয়টি ছিল তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারন একমাত্র জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ দূর করতে পারে সমাজের সমস্ত অন্ধকার।

শৃঙ্খলা ছিল তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের অঙ্গ। ক্লান্তি তার কাছে হার মেনেছে সব সময়। খেলাধূলা ছিল তার সহজাত বিষয়। এমনকি তিনি যখন অর্থমন্ত্রী একটু সূযোগ পেলেই ব্যাডমিন্টন খেলেছেন। সাইকেল চালিয়ে চলে গেছেন সরেজমিনে কোন কিছু জানতে। ভন্ডামি-শঠতা থেকে তার অবস্থান ছিল লক্ষ কোটি মাইল দূরে।

মনের দৃঢ়তা, গভীর জ্ঞান, সরলতা তাকে সকল মানুষের মাঝে বিশ্বস্ত কর্মোদ্যোগী গুণী মানুষের মর্যাদায় সিক্ত করেছে অনায়াসে। প্রকৃতির কাছ থেকে তিনি সংগ্রহ করেন প্রাণশক্তি। রোদ, বৃষ্টি মেঘ, মানুষের জীবন থেকে ফসলের মাঠে যে ভূমিকা রাখে তা থেকে তিনি নিরূপন করেন সমাজের দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না, আনন্দ।

তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের সমাজে এক অনন্য অনুকরণীয় মানুষ। যে মানুষ সমাজে সচরাচর বিরল। যিনি প্রতিটি সময়ে স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে বেঁচে থাকার পথ নির্দেশ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের মত মানুষেরা যুগে যুগে জন্ম নেন না। এই ক্ষণজন্মা মহাপ্রাণ মানুষেরা বিশ্বকে আলোকিত করেন তাদের চিন্তা কর্ম এবং আহবানে। যা প্রতিনিয়ত পথ দেখায় আজ, আগামী এবং অনাগত ভবিষ্যৎকে। আমরা যেনো সুখী সমাজ এবং আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তাজউদ্দীন আহমদের মত মানুষদের যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশকে মর্যাদাসিক্ত করতে পারি।

২৩ জুলাই ২০২০, তাজউদ্দীন আহমদের ৯৫ তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি অর্পন করছি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : জাতীয় সংসদ সদস্য, লেখক ও সমাজকর্মী

পিডিএসও/এসএম শামীম

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
তাজউদ্দীন আহমদ,জন্মদিন,শ্রদ্ধাঞ্জলি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close