লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ১০ অক্টোবর, ২০২১

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ

তরুণদের মানসিক সমস্যায় প্রভাব ফেলছে করোনা

মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের সুস্থতার অন্যতম প্রধান অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ সংজ্ঞায় দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার কথা বলা হয়েছে। দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য দৈহিক সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ। তবে যথাযথ কর্মশক্তি থাকার পরও মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে কাজের উদ্যম বা চালিকাশক্তি হ্রাস পায়। জীবনের সবপর্যায়ে বিভিন্ন চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারাকেই মানসিক সুস্থতা বলা হয়। বর্তমানে করোনার ভয়াবহতা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কতক বিষয়সব বয়সের মানুষকে বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও তরুণদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। করোনাকালে এ ভয়াবহ রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২১ উপলক্ষে বিশ্বের সব দেশকে ÔMental health care for all : Let's make it a reality- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মানসিক সুস্থতার নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্ব অতিমারির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর না হলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় এ শতকে পৃথিবী নামক এ গ্রহটিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব করোনাভাইরাস যেভাবে শফঙ্কত করে তুলেছে, তাতে মানুষের অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। এ পর্যন্ত ২২৩টি দেশের সাড়ে তেইশ কোটিরও বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে ৪৮ লাখের ওপর।

এই মহামারিতে শিশু-কিশোররা অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হলেও মানসিক আঘাতটা সবচেয়ে বেশি এসেছে তাদের ওপর। অতিমারি প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে বিশ্বের ১৬ কোটি শিশু স্কুলজীবন শুরু করতে পারেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খেলাধুলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, পারিবারিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপের ঝুঁকিতে পড়েছে। তরুণ শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা দেখা দিচ্ছে সারা বিশ্বে; বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশসমূহে।

অতিমারির অনেক বিষয় বুঝতে না পারা, পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশন বা হাসপাতালে ভর্তি থাকা এবং করোনা প্রোটোকল মানতে আলাদা আলাদা অবস্থানে থাকা শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব রাখে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিও ছেলেমেয়েদের ওপর দুর্ব্যবহার, অবহেলা, অনাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশসমূহে ইবোলা মহামারির প্রাদুর্ভাবের সময় তরুণদের মধ্যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও মানসিক ভারমসাম্যহীনতা দেখা যায়।

চীনে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে লকডাউন চলাকালে শিশুদের ওপর পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা প্রায় ৪ গুণ বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এক জরিপেও অনুরূপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে তালাকপ্রাপ্ত/প্রাপ্তা অথবা আলাদা বসবাসকারী বাবা-মা পরিবারে শিশুদের ওপর বকাবকি, মারধর, মানসিক পীড়াদায়ক ঘটনার আধিক্য দেখা যায়। করোনাকালে জার্মানির এক গবেষণায় মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের ৬০ ভাগ মানসিক চাপ, একাকিত্ব ও চরম বিরক্তিতে ভুগছে বলে তথ্য উঠে আসে। তারা বলেছে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না পারা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে না থাকা, পছন্দের খেলাধুলা ও শখের কোনো কাজে অংশ নিতে না পারা, পারিবারিক কলহে জড়িয়ে পড়া, মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব, ঘরের বাইরে বের হতে না পারা, প্রাত্যহিক রুটিন অনুসরণ ও স্কুলের হোমওয়ার্ক না করা, করোনা আক্রান্তের ভয়, স্ক্রিন টাইম বাড়াতে বকাবকির স্বীকার হওয়া ইত্যাদি কারণে সব সময় শিশুরা মানসিক চাপে থাকছে।

অপেক্ষাকৃত তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে রুক্ষ ব্যবহার, নিদ্রাহীনতা, মানসিক চাপ, হতাশা, দুঃখবোধ, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের থেকে পৃথক থাকার কষ্ট বা মানসিক দুঃখবোধ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। উঠতি বয়সি তরুণদের মধ্যে মূলত হতাশা, সহজে নার্ভাস হয়ে পড়া, স্মৃতিকাতরতা লক্ষ করা যায়। আগে থেকে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে করোনাকালে বিভিন্ন কারণে পারিবারিক অবহেলার জন্য হতাশা, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ আরো ঝেঁকে বসে। কোভিড-১৯ সন্দেহে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকা ছেলেমেয়েদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, অহেতুক ভীতি, সামাজিক কুসংস্কার ও হতাশা প্রভৃতি মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এক জরিপে তরুণদের অর্ধেক করোনাকালে শারীরিক নির্যাতন এবং আটজনে একজন মানসিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছে। বাংলাদেশে এক গবেষণায় প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলেমেয়ে হতাশা, দুশ্চিন্তা কিংবা মানসিক চাপে ভোগার তথ্য পাওয়া যায়। বেশ কিছু জরিপে করোনাকালে শিশুদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার হার বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায়। যেমন- ঘুম বা ক্ষুধার পরিবর্তন, নিজের পছন্দের কাজ বা শখের প্রতি অনাগ্রহ, পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, আবেগের বিরূপ প্রকাশ, স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন, দৈনন্দিন বিষয় বা জরুরি ইস্যুগুলো ভুলে যাওয়া, স্ক্রিন টাইম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, ইটারনেট বা ইলেকট্রিক গেজেটে আসক্তি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

শতাধিক দেশের জরিপে দেখা গেছে করোনাকালে শিশু-কিশোরদের টিকাদান ও স্বাস্থ্যসেবা ৩০ শতাংশ কমে গেছে। পুষ্টিসেবায় ৪০ শতাংশ হ্রাস, ২৫ কোটি শিশু স্কুল টিফিন থেকে বঞ্চিত হওয়াও শিশু ভিটামিন-এ ক্যাপসুল কর্মসূচি থেকে বাদ পড়াসহ বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন, খাবার পানি প্রভৃতি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সুতরাং করোনাকালে এসব ঘাটতি তরুণদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার প্রকোপ বাড়তে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ বা ২ কোটি লোক এবং তরুণদের মধ্যে প্রায় ১৮ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ভুগছে। করোনাকালে এ হার অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বেড়ে গেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। অঞ্চলভেদে এর তারতম্য প্রায় ৭ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দেখা যায়। নারীদের আক্রান্ত হওয়া এবং ঝুঁকি দুটোই বেশি। বস্তি এলাকার তরুণদের মধ্যে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। এক কথায় আমাদের দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে।

করোনা অতিমারির বর্তমান পরিস্থিতিতে ৩২টি দেশের প্রায় ৪ লাখ মানুষের ওপর গবেষণায় কোভিড-১৯ পরবর্তী মানসিক অবস্থার বেশ অবনতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এক গবেষণায় ২৮ ভাগ মানুষের হতাশা, ২৭ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তা, ৩৭ ভাগের মধ্যে মানসিক চাপ এবং প্রায় ২৮ ভাগ মানুষের নিদ্রাহীনতা দেখা যায়।

পৃথিবীর প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক ব্যাধিতে ভুগে থাকে। মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ৯০ ভাগই চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যায়। তরুণদের মধ্যে এ প্রবণতা আরো বেশি। মানসিক সমস্যা তারা শেয়ার করতে চায় না, এমনকি পরিবারের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গেও। এ ব্যাপারে সচেতনতার অভাব রয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশের মধ্যে।

শিশু-কিশোর ও তরুণদের মানসিক অসুস্থতা প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে,

১. তরুণদের কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে শিশু-কিশোরদের সাহস জোগাতে হবে। তারা আক্রান্ত হলে নীতিমালা অনুসরণ করে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে থাকলে তাদের সঙ্গে সময় দিতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতার শিক্ষা দিতে হবে।

২. ভীতিকর খবরাখবর প্রচারের সময় টেলিভিশন বন্ধ রাখতে হবে। কোভিড-১৯-সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা সীমিত রাখতে হবে। মিডিয়ায় মহামারির খবরাখবরের দিকে বিশেষ মনোযোগ না দিয়ে ভালো খবর দেখার বা শোনার উৎসাহ দিতে হবে।

৩. ছেলেমেয়েদের স্ক্রিন টাইমের প্রতি নজরদারি রাখতে হবে। ভিডিও গেম বা স্ক্রিন কার্যক্রমের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা যেতে পারে। তাদের কম্পিউটার, স্মার্টফোন ইত্যাদির সঙ্গে সময় কাটানো হ্রাস করতে হবে। তবে উঠতি বয়সি তরুণদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও বা টেলি কনফারেন্সিং ও ভিডিও চ্যাটিংয়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

৪. পরিবারের রুটিনকাজের সঙ্গে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রান্না-বান্নার কাজে তাদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। তাদের কাছে বসিয়ে আদর-যত্নে সঙ্গে কথাবার্তা গল্প বা তাদের কথা শুনতে হবে। মনের কষ্ট-বেদনা শেয়ার করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জন্মদিন উৎসব ও পারিবারিক আড্ডার আয়োজন করা যেতে পারে।

৫. বই পড়া, ছবি আঁকা ও বিভিন্ন ধরনের ইনডোর খেলাধুলায় মনোযোগী করার চেষ্টা করতে হবে। ৫. ঘুমের রুটিন নিশ্চিত করতে হবে। প্রাত্যহিক রুটিন অনুসরণে সচেতন করে তুলতে হবে।

কোভিড-১৯ যুদ্ধকালে তরুণদের মানসিক অসুস্থতা ও অস্থিরতাই বাস্তবতা। এ বিষয়টি উপেক্ষা করলে তরুণদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক শারীরিক ও মানসিক প্রভাব পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য, বিশেষ করে বাবা-মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। করোনাকালে বাবা-মাকে নিজেদের সুস্থ রাখা এবং পরিবারের ছেলেমেয়েদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

লেখক : সহকারী পরিচালক

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মানসিক সমস্যা,করোনাভাইরাস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close