মুস্তাকিম আহমেদ

  ০২ জুন, ২০২৩

শিশুর জন্য ওয়াকার কতটা বিপজ্জনক

ছবি : সংগৃহীত

ভাবুন তো, প্রবাসে আপনার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে! চারিদিকে সাজ সাজ রব! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আপনি তার জন্য কিনে ফেললেন একখানা আস্ত ওয়াকার!

বৈঠকখানায় আপনার সন্তান, তার মা এবং ওয়াকারকে সাথে নিয়ে খুব কায়দা করে যেই না একটা সেলফি তুললেন, অমনি…ডিং, ডং কলিংবেল! আপনি দরজা খুললেন। ‘আপনাকে জরিমানা করা হয়েছে’। কিন্তু কেন? কারণ, আপনার কাছে ওয়াকার আছে। জরিমানার অংকটি দেখে তো আপনার আক্কেল গুড়ুম! এক লাখ ডলার!

কানাডার পণ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী শিশুদের ওয়াকার তৈরি করা, আমদানি করা, বিজ্ঞাপন দেওয়া এবং ওয়াকার বিক্রি কানাডায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই দেশে কারো কাছে ওয়াকার পাওয়া গেলে তাকে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হতে পারে।

আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স মার্কিন মুল্লুকেও এই নিষেধাজ্ঞা চান। কেন? কারণ শিশুদের জন্য ওয়াকার বিপদজ্জনক। পেডিয়াট্রিক্স জার্নালের (অ্যামেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স) গবেষণায় এই ওয়াকারের ভয়াবহতা উঠে এসেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ওয়াকারের কারণে আহত হয়েছে এমন শিশুর সংখ্যা এই গবেষণায় জানা যায়। সংখ্যাটি চমকে দিতে বাধ্য। ২ লাখ ৩০ হাজার শিশু (যাদের বয়স ১৫ মাসের কম)।

ওয়াকারে থাকা অবস্থায় শিশু সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করে মারাত্মক আঘাত পেতে পারে। ওয়াকারে শিশুর আঙুল আটকে যেতে পারে। হাতের নাগালে থাকে না এমন জিনিস যেমন ধারালো বস্তু, গরম পানি, তরকারি হঠাৎ নাগালে পেয়ে সে টান দিতে পারে। ওয়াকারের ভিতরে থেকে সে ওয়াকার নিয়েই পড়ে ব্যথা পেতে পারে।

তবুও মা-বাবারা কেন ওয়াকার ভালোবাসেন?

শিশু দ্রুত হাঁটতে শিখবে এই ভেবে মা-বাবারা ওয়াকার কেনেন। বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ওয়াকার ব্যবহারে শিশুর স্বাধীনভাবে হাঁটতে শেখায় দেরি হয়।

হাঁটা মানে শুধু নিজের পা জোড়ার ব্যবহার জানা নয়।

হাঁটার কয়েকটি ধাপ আছে।

দাঁড়াবে, ভারসাম্য রাখবে, কোন সাহায্য ছাড়া এক কদম, দুই কদম আগাবে- এভাবেই শিশু হাঁটতে শেখে। ওয়াকারে থাকলে এর কোনটাই শেখা হয় না।

মা-বাবারা ওয়াকার পছন্দ করার আরেকটি কারণ হচ্ছে শিশুরা ওয়াকার ভালোবাসে, ওয়াকারে থেকে খেলতে মজা পায়। ওয়াকারে সে কোনভাবেই নিরাপদ নয়

ছয় মাস বয়স থেকেই শিশুরা সোজা হতে চায়, স্বাধীনভাবে চলতে চায়। নানারকম জিনিস ধরা, ঘ্রাণ নেওয়া, চেখে দেখাতেই তাদের আনন্দ। ওয়াকারে থাকলে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।

সচেতনতা, দেখে রাখা, সতর্কীকরণ লেবেল, চাকা আটকে রাখে এমন স্ট্যান্ড –দুর্ঘটনা এড়াতে এর কোনকিছুই যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি। ওয়াকারে এরপরেও বাচ্চারা আঘাত পায়। ওয়াকারের কারণে শিশুদের বিকাশ দেরিতে হয়। বিষয়টি দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

প্রথমত, ওয়াকার একটি শিশুকে সময়ের আগেই চলাচল করার কৃত্রিম অনুভূতি দেয়। এই অনুভূতি তার স্বাভাবিক বিকাশ, হাঁটাচলা শেখাকে বাধাগ্রস্ত করে।

দ্বিতীয়ত, নিজের হাত, পা নড়ছে, শরীর নড়ছে- একটি শিশু হাঁটার সময় এই দৃশ্য দেখা গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্কের মটর সিস্টেম আমাদের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। ওয়াকারের ভিতরে থাকলে মটর সিস্টেম বাধা পায়। ওয়াকারে থাকা অবস্থায় শিশু ৩ ফুটের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে মাত্র এক সেকেন্ডে!

এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক ওয়াকার নিয়ে কিছু ভ্রান্তি এবং বাস্তবতা।

ভ্রান্তি ১- শিশুকে কয়েক মিনিটের জন্য ওয়াকারে রাখা নিরাপদ।

বাস্তবতা : শিশু একা থাকার থেকে ওয়াকারে থাকলে তাকে আরো বেশি চোখে চোখে রাখতে হয়। পরিসংখ্যান বলছে শতকরা ৪০ ভাগ শিশু ওয়াকার ব্যবহারে অবধারিত ভাবে ব্যথা পাবে (যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর ৪ হাজার শিশু ওয়াকারের কারণে আঘাত পায়)।

ভ্রান্তি ২- ওয়াকার শিশুদের হাঁটা শিখতে সাহায্য করে।

বাস্তবতা : ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের একটি গবেষণাপত্র জানাচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। যত বেশী ওয়াকার ব্যবহার করা হয়, শিশুর দাঁড়ানো এবং হাঁটা তত পিছিয়ে যায়। আপনি যদি মোট ২৪ ঘণ্টা শিশুকে ওয়াকারে রাখেন তার হাঁটতে শেখা পিছিয়ে যাবে ৩ দিন এবং সে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৪ দিন পর দাঁড়াবে। ওয়াকার শিশুকে সোজা করে আটকে রাখে। এতে শিশুর হাঁটার জন্য প্রয়োজনীয় ভারসাম্য শেখা হয় না।

ভ্রান্তি ৩- শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে ওয়াকার সহযোগিতা করে।

বাস্তবতা : গবেষণায় জানা যায়, যে শিশুরা ওয়াকার ব্যবহার করেছে তাদের হামগুড়ি দেওয়া, বসা, হাঁটা যে শিশুরা ওয়াকার ব্যবহার করে না, তাদের থেকে দেরিতে হয়েছে। শুধু তাই নয় তারা মানসিক বিকাশ, ভাষাগত দক্ষতাতেও পিছিয়ে।

আমাদের মস্তিষ্ক আড়াআড়িভাবে কাজ করে। মস্তিষ্কের বাম অংশ ডান হাত ও ডান পা’কে নিয়ন্ত্রণ করে আর মস্তিষ্কের ডান অংশের কাজ বাম হাত ও বাম পা’কে নিয়ন্ত্রণ করা। হামাগুড়ি দিলে শিশুর মস্তিষ্কের এই আড়াআড়ি কাজ করা উৎসাহিত হয়। ওয়াকারে থাকলে শিশু হামাগুড়ি দিতে পারে না।

ওয়াকার ব্যবহারকারী শিশুর মধ্যে ‘দূরত্ব, গভীরতা, ভেতর, বাহির, উপর, নীচ’ এই ধারণাগুলো তৈরি হয় না।

ভ্রান্তি ৪- ওয়াকার ব্যবহারে শিশুর পা মজবুত হয়।

বাস্তবতা : ওয়াকার শিশুকে তার স্বাভাবিক দেহভঙ্গি শিখতে বাধা দেয়। এতে শিশুর পা এবং নিতম্ব একটি অস্বাভাবিক অবস্থায় তার দেহের ওজন নেয়। এই অস্বাভাবিকতা শিশুর সুন্দর হাঁটার ছন্দকে নষ্ট করে। ওয়াকার শিশুকে তার পায়ের পাতার উপর ভর করে দ্রুত চলতে উৎসাহিত করে। এই অভ্যাস শক্তিশালী করে তার পায়ের ভুল পেশিকে। ফলে পা, গোড়ালি, নিতম্বে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা, ভারসাম্যে অসুবিধা এবং হাড় ও পেশির অপর্যাপ্ত শক্তি। শিশুকে যথেষ্ট সময় এবং উৎসাহ দিতে হবে। তার পেশিতে শক্তি এবং দেহের ভারসাম্য এসে গেলে ৯-১৮ মাস বয়সে শিশু হাঁটবে। সক্রিয়তা আপনার সন্তানকে হাঁটার জন্য প্রস্তুত করে। ওয়াকারে থাকলে তা ব্যহত হয়। শিশুকে ওয়াকারে দেওয়া একজন কিশোরকে ফেরারি চালাতে দেওয়ার মতই বিপজ্জনক। তাই শিশুর জন্য ওয়াকারকে না বলুন।

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক; বিজনেস, মাস্টারমাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ওয়াকার কতটা বিপজ্জনক,শিশু
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close