মজিবুর রহমান খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

  ১১ মার্চ, ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক

এক অপারেশনে ৩৫ সেনাকে হত্যা করি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মাতৃভূমির টানে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বাসুদেব ইউনিয়নের ঘাটিয়ারা গ্রামের রেজাউল হক। ১৯৬৩ সালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দিয়েছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক বলেন, ‘একাত্তরের ৭ মার্চ আমি এবং ইপিআরে কর্মরত আমার দুই বন্ধু আবুল হোসেন ও আকরাম রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে। ভাষণ শোনার পর আমি মুক্তিকামী হয়ে ওঠি। পিলখানায় কর্মরত আমরা বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। ২৩ মার্চ রাতে আমরা সাতজন পিলখানার প্যারেড গ্রাউন্ডের বটগাছে বাংলাদেশের পতাকা সাঁটিয়ে দিই। পরদিন ২৪ মার্চ সকাল ৯টায় পাকিস্তানিরা ওই পতাকা দেখার পর গাছ থেকে নামিয়ে আমাদের ইন্টেলিজেন্টস্ অফিসে নিয়ে রাখে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী পিলখানায় বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। রাতেই আমি জীবন বাজি রেখে আমাদের ইন্টেলিজেন্টস্ অফিসের পেছনদিকে টয়লেট দিয়ে পিলখানা ত্যাগ করি। পুরো ঢাকায় তখন গোলাগুলি চলছিল। তিন দিন পর ২৮ মার্চ রাতে হেঁটে গ্রামের বাড়ি ঘাটিয়ারার উদ্দেশে রওনা হই। হাঁটতে-হাঁটতে আমি ডেমরা পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ ঘাটে আসি।’

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান প্রসঙ্গে রেজাউল হক বলেন, ‘পিলখানায় পাকিস্তান বাহিনীর হামলার কথা শুনে আমার পরিবার ও গ্রামের লোকজন মনে করেছিল আমি মরে গেছি। ২৯ মার্চ আমি বাড়িতে যাওয়ার পর গ্রামের সবাই আমাকে দেখতে আসে। এরপর আমি গ্রামের কিছু ছেলেকে সংগঠিত করলাম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে খবর পাই, শীতকালীন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ফোর বেঙ্গলের ডি কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এম আইন উদ্দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছেন। আমি ও আমার ভাই সাইদুল হক এবং চাচা আবদুল কাদের ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের কাছে গিয়ে বলি ওনার সঙ্গে আমাদের রাখার জন্য। আমি ইপিআরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য হওয়ায় আমাকে তিনি স্বাগত জানালেন। কিন্তু যুদ্ধ শুর হওয়ার কারণে আমরা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকতে পারলাম না। ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের মাধ্যমে আমরা ৭০-৮০ জন ১৭ এপ্রিল চলে যাই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহরের চারিপাড়ায়। সেখানে আমাদের নিয়ে একটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। এরপর আমরা কে কোন এলাকায় যুদ্ধ করব সেটি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আমরা ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা মনতলী সাব-সেক্টরে যোগ দিই। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। আর ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন ছিলেন মনতলী সাব-সেক্টরের কমান্ডার। আমরা যেহেতু ইপিআরের প্রশিক্ষিত সৈনিক ছিলাম তাই যুদ্ধের জন্য আর নতুন করে প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। আমাকে তখন সিকিউরিটি বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার কাজ ছিল পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পের খবরা-খবর সংগ্রহ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করা এবং কোন জায়গা থেকে ফায়ার করা যাবে সেটির ছক বানিয়ে দেখানো। এরপর আবার পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা।’

এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার কিছু অংশ এবং কসবাসহ ২ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় যুদ্ধ করেছি। হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য কয়েকটি সেতুও ধ্বংস করেছিলাম। এপ্রিল মাস থেকে আমরা বিভিন্ন জায়গায় অনেক অপারেশন চালিয়েছি। অনেক পাকিস্তানি সৈন্য মেরেছি। এর মধ্যে আমাদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধে আমার ভাই সাইদুল হক তার পা হারিয়েছেন। ৬ ডিসেম্বর ভোরে আমরা আখাউড়ার গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশনের পাশে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করি। ওই অপারেশনে একসঙ্গে ৩৫ জন সেনাকে হত্যা করেছিলাম আমরা।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অপারেশন,সেনাকে হত্যা,বীর মুক্তিযোদ্ধা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close