reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অন্ধকারের পথে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র!

ফাইল ছবি

আড়াই বছরেরও বেশি সময় আগের কথা। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি। মার্কিন সরকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক নজিরবিহীন প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। সেদিন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা নির্বাচনের ফল পাল্টে দিতে ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায়। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে নিজেদের জাহির করা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এমন ঘটনা অভাবনীয় ছিল। বিশ্বজুড়ে এ ঘটনা ব্যাপক আলোড়নও সৃষ্টি করে।

দশকের পর দশক ধরে গণতন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে নিজেদের দাবি করে আসছেন আমেরিকানরা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষে নিতে খুব কম দেশের পার্লামেন্ট ভবনেই এমন জঘন্য হামলার ঘটনা ঘটেছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জোসেফ রবিনেট বাইডেনের কাছে নিজের পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করেন ট্রাম্প। এরপরে আড়াই বছর পার হলেও পরাজয় স্বীকার করেননি তিনি। যদিও ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন এই রিপাবলিকান।

২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ আমেরিকানই মনে করেন তাদের দেশের গণতন্ত্র হামলার মুখে। তখন ৫১ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মত দিয়েছেন, ভবিষ্যতে নিজেদের দল জয়ী হতে না পারলে নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোটের ফল সফলভাবেই উল্টে দিতে পারবেন।

৫৬ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হামলার মুখে পড়েছে। আর ৩৭ শতাংশ মত দিয়েছেন, দেশের গণতন্ত্র এক কঠিন পরীক্ষার মুখে। অর্থাৎ অধিকাংশ আমেরিকানের ধারণা, তাদের সরকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মারাত্মক নাজুক অবস্থায় পড়েছে। মাত্র ছয় শতাংশ আমেরিকান জানিয়েছেন, তাদের গণতন্ত্রের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই।

ওই জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলীয় সমর্থকরা মনে করেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে তাদের কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের ধারণা, ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলেও তাকে পরাজিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকলেও তাদের মতে, ওই নির্বাচনে জো বাইডেন বিজয়ী না। আর গেল সপ্তাহে বাইপার্টিজান পলিসি সেন্টারের এক জরিপ বলছে, মার্কিন গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তারা হতাশ।

দ্য হিলের খবরে জানা যায়, ৮২ শতাংশ ভোটার জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে হতাশ। তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ বলেছেন, তারা ‘খুবই হতাশ’। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট- দুই দলের সমর্থকরাই এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।

গেল জানুয়ারিতে ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উন্নতির দিকে যাচ্ছে। দেশটিতে ২০২২ সালের নির্বাচনগুলো সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তখন নির্বাচনী ফল অস্বীকারকারীরা অ্যারিজোনা ও পেনসিলভানিয়ার মতো দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে হেরে গেছেন। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, নানা কারণে মার্কিন গণতন্ত্র ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়েছে।

ক্যাপিটল হিলের হামলার ঘটনায় গঠিত মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল উল্টে দিতেই ওই দাঙ্গা হয়েছে এবং তাতে ট্রাম্পের ভূমিকা হামলাকারীদের প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে সরাসরি জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।

ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীর নিবন্ধ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সুষম গণতন্ত্র অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হলে বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে দেশটির দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া।

২০২২ সালের ১৫ আগস্ট দ্য নিউ ইয়র্কারের এক নিবন্ধে বলা হয়, রিপাবলিকানদের অভিযোগ, তাদের বিরোধীরা অর্থাৎ ডেমোক্র্যাট দল নির্বাচনে জালিয়াতি করেছেন। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, মার্কিন গণতন্ত্র কতটা অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। একটু কঠোর ভাষায় বললে, আমেরিকান সরকার কখনোই জনগণের পরিচালিত সরকার ছিল না।

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ আমেরিকান ভোট দিয়েছিলেন। ১৯০০ সাল থেকে সেখানকার নির্বাচনে এতো ভোট আর কখনো পড়েনি। তখন মোট নাগরিকের ৮০ শতাংশ ভোট দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট থাকাকালেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আসছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে হোয়াইট হাউসকেও জড়িয়ে ফেলেছিলেন। মার্কিন অনেক সংবাদমাধ্যম তাকে জনগণের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। বিদেশি একনায়কদের সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল তার। বিজ্ঞানকেও পাত্তা দিতেন না। মার্কিন বিচার বিভাগকে রাজনীতিকীকরণ করেন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতিও তার কোনো আস্থা ছিল না।

ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ই নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এছাড়া মার্কিন ভোটারদের জন্য আরও একটি বাধা রয়েছে। সেখানে শুদ্ধির নামে কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘুদের ভোটার তালিকা থেকে ভুলভাবে বাদ দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

প্রটেক্ট ডেমোক্র্যাসির নির্বাহী পরিচালক ইয়ান বাসিন বলেন, এ রকম একটি প্রবণতা আমরা রিপাবলিকান দলের মধ্যে দেখেছি। কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘুদের জন্য ভোট দেয়া কঠিন করে তোলা হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এমন প্রবণতা আছে কিনা; আমাদের জানা নেই, যেখানে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের একটি তাদের প্রধান কৌশল হিসেবে ভোটার দমনে বিনিয়োগ করে।

ভোটার দমনের সবচেয়ে খারাপ নজির তৈরি করেছে ফ্লোরিডা রাজ্য। ২০১৮ সালে রাজ্যটিতে হত্যা ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধীদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কৌশলগতভাবে ১৪ লাখ লোককে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়।

এরপর নির্বাচকমণ্ডলীর ইচ্ছাকে খর্ব করতে নতুন একটি অপকৌশল বেছে নিয়েছিল রাজ্যটি। তারা এমন এক আমলাতন্ত্রিক গোলকধাঁধা তৈরি করে যে, ভোট দেয়ার আগে সাবেক অপরাধীদের আলোচনা করতে হবে। এতে নির্বাচনের দিন ৯ লাখ নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। যার মধ্যে ফ্লোরিডার ভোট দিতে সক্ষম প্রতি ৬ কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে একজন রয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যমও নজিরবিহীন হামলার মুখে পড়েছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের বৈশ্বিক রাজনীতির সহযোগী অধ্যাপক ব্রিয়ান ক্ল্যাস এক লেখায় বলেন, মার্কিন গণতন্ত্র মুমূর্ষু অবস্থায়। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র মারা যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসার অনেক ওষুধ আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো আমাদের রাজনৈতিক অকার্যকারিতা, মানে আমরা সে সব ওষুধ ব্যবহার করছি না।

তিনি আরও বলেন, এভাবে সময় চলে যাওয়ার পর খুব কমই সুযোগ আমাদের জন্য অবশিষ্ট থাকবে। যদিও রোগ নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। কারণ গণতন্ত্রের পক্ষে কংগ্রেসে বড়ো ধরনের কোনো সংস্কারমূলক আইন পাশ করা হয়নি। যারা নির্বাচনের ফল পাল্টে দিতে ক্যাপিটল হিলে হামলায় প্ররোচিত করেছেন, এমন কোনো বড়ো রাজনৈতিক নেতাকেও জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হয়নি। মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য যেই প্রেসিডেন্টকে সবচেয়ে বড়ো হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তিনিও আবার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করছেন।

হার্ভার্ড ল’ স্কুলের অধ্যাপক মাইকেল ক্ল্যারম্যান বলেন, বর্তমানে যারা জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে কেউই মার্কিন গণতন্ত্রকে এতোটা হুমকির মুখে কখনো দেখেননি।

বিশেষজ্ঞ কিংবা সাধারণ আমেরিকান- সবারই ধারণা, মার্কিন গণতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করছে না। গেল ২৩ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়, মার্কিন গণতন্ত্র ভেঙে পড়ছে। সাধারণ আমেরিকানরা মনে করেন, তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাজ করছে না। নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করতে রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, বৈষম্য, বন্দুক, ঋণ ও ঘাটতি নিয়ে সরকার ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো মতৈক্য নেই। এসব বিষয় নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো অর্থনীতির দেশটির সাধারণ মানুষও বিভক্ত। কোথাও কোথাও এই বিভাজন তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছে।

জনগণের প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থতার জন্য মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেও অসন্তোষ ও হতাশা রয়েছে। এমনকি এসব অসঙ্গতির খুব একটা সমাধানও দেখা যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলছেন সাধারণ মানুষ। বড়ো দুই দলের মতাদর্শিক ব্যবধান এতোই বেশি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাদের মধ্যে কোনো ঐকমত্য নেই।

পিডিএস/এমএইউ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
যুক্তরাষ্ট্র,জো বাইডেন,ডোনাল্ড ট্রাম্প,হিলারি ক্লিনটন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close