সবুজ হোসেন, গণমাধ্যমকর্মী

  ০৩ আগস্ট, ২০২১

হাতছানি দিয়ে ডাকছে সুন্দর ভোর

জীবন খেয়ার পিচ্ছিল পথে সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই আছে। ‘দৃষ্টির মায়াজাল ঘেরা চোখের মাঝে আমরা কতই না আশা আর ভরসার ভেলা দেখছি প্রতিনিয়ত’ চারপাশে একটু দৃষ্টিপাত করলে ভেসে ওঠে কত মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতার কতশত গল্পগাথা। এক নিমেষে রাজার রাজ্য শূন্য হতে দেখা যায়। আবার আলাদিনের জাদুর চেরাগের গল্পের মতো রাতারাতি ধনকুবের মালিক হয়ে যায় অনেকে। সব কিছুই যেন এই সৃষ্টিকূলের মাঝে বিরাজমান। তবে কি আমরা সেই সাফল্যের পেছনে লাগামহীনভাবে ছুটবো, যে সাফল্যের মাঝে কোনো ত্যাগ, পরিশ্রম ও সততার গল্প নেই। যে সাফল্যের গল্পে আছে ঘৃণা ও এক নিমেষেই সবটুকু মিথ্যা প্রাপ্তির হারানোর ভয়। তা কখনোই আমাদের কাম্য হতে পারে না।

পৃথিবীজুড়ে ইতিহাসের পাতায় যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, তারা সবাই পৃথিবীতে সঠিক পথে চেষ্টা, শ্রম, সাধনা ও সততার মাধ্যমে নিজেদের মেধা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মানবকূলের এক কোণে ভরসাহীন এক পথের যাত্রী আমরা। কখন যে সাধের দম ফুরিয়ে যায়। তার কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল কারো জানা নেই। তাই এমন কিছু কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে হবে, যাতে কেউ বলতে না পারে ভুল পথের যাত্রী ছিলেন।

আমাদের সুন্দর কাজ, স্বচ্ছতার সাথে বসবাস করার মাধ্যমে গড়ে তোলা উচিত ব্যক্তি ও কর্মজীবন। গরিবের অর্থ লুটে, মদ-জুয়ার আসর বসিয়ে কিম্বা বে-আইনে পথে অঢেল টাকার পাহাড় গড়ে ব্যাংক-ব্যালেন্স করে রাতারাতি খ্যাতি ও সাফল্য অর্জন করার মাঝে পরম কোন তৃপ্তি থাকে না। সেই তৃপ্তি হয়তো ক্ষণিক সময়ের জন্য জীবনকে রঙিন আলোয় আলোকিত করবে। সেখানে আশানূরুপ সুখ থাকে না। তা অচিরেই হারানোর এক মহা আতঙ্ক মনে ভর করে থাকে। যার প্রমাণ চারপাশের ঘটে নানা উত্থান-পতনের ঘটনায় পরিলক্ষিত।

ক্ষণিকের সাফল্য ও খ্যাতি অর্জনের নামে অনেকেই মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিচ্ছি। ফলে প্রতিনিয়ত পরিশুদ্ধ অন্তরে জমা হচ্ছে লোভ, লালসা, অহংকার, মিথ্যাচার, ক্ষমতা ও দাম্ভিকতার বড়াই। যার কারণে আমাদের মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিতে দ্বিধা করছি না। সৃষ্টির সেরা জীবন হয়েও মানুষে-মানুষে প্রতিহিংসার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। যার মধ্যে দিয়ে মানবকূল কুলষিত হয়ে যাচ্ছে এমন বিপদগামী ভুল পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে। এমন কর্মকাণ্ডে কখনো একটি জাতি উপকৃত হতে পারে না। এ থেকে কোনো শিক্ষা অজনের্র কিছু নেই তরুণ প্রজন্মের। একজন শিশু জন্ম নেয় নিষ্পাপ হয়ে। সে চারপাশের নির্মল আলোর স্থলে যদি নোংরা রঙিন আলোর মাঝে বেড়ে ওঠে, তবে সেই শিশু কি শিখবে এ এমন ঘুণে ধরা সমাজ থেকে। আজকের তরুণ প্রজন্ম হবে আগামী দিনের দেশ ও জাতির কর্ণধার কিন্তু বর্তমান সময়ের পরিক্রমায় অনেক তরুণ প্রজন্ম মাদক, নেশা ও অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিভে ফেলছে জীবনের আলোকবর্তিকা। যে প্রজন্মের গড়ে ওঠবে ন্যায়, নীতি ও আদর্শের ধারক ও বাহক হয়ে। সেই প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে অতল অন্ধকারের এক গহব্বরে। সে দায় কে নেবে, এর জবাব কে দেবে, কেন এমন হবে, এমনটা তো প্রত্যাশা নয়।

চলুন একটি উদারহণ দিয়ে বাস্তবতা অনুধাবন করার চেষ্টা করি, এক সন্তানের বাবা একটি সরকারি অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মকতা মাসে তার বেতন ২৫ হাজার টাকা। চাকরিতে প্রবেশের পর বছর না ঘুরতেই বাড়িতে দামি আসবাবপত্র, পরিবারের জন্য দাবি অলংকার, প্রসাধনীসামগ্রী থেকে শুরু করে জীবনযাত্রায় এসেছে আমূল পরির্বতন। দিন যতই যাচ্ছে, বাড়ি-গাড়ি ব্যাংক-ব্যালেন্সসহ সব কিছুতে উন্নত এক জীবনযাপনের ছোয়াঁ লেগেছে। সেই সন্তান তার বাবাকে দেখে কি শিখবে বা তার বাবা তাকে কতটুকু সু-শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে। ছোটবেলা থেকেই যে সন্তান তার পরিবার ও চারপাশে অন্যায় করে খ্যাতি ও অর্থবিত্তের মালিক হতে দেখেছে সেই সন্তান বড় হয়ে এ জাতিকে ভালো কিছু উপহার দিবে কি করে। সব সন্তানের কাছে থেকে এমনটা কিভাবে আশা করা যায়।

অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই অনেক সন্তানদের শিক্ষা দেয়া হয় লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পুলিশ বা বড় কোনো অফিসার হতে হবে। নইলে জীবনে সাফল্য অর্জন করা সম্বব নয়। এই একটি ভুল চিন্তাধারা পরিবারের সদস্যরা তাদের সন্তানদের চাপিয়ে দেয়। তাহলে সেই সন্তান কি করবে ভবিষ্যতে। অনেক পরিবারের সন্তান এমন চাপ সহ্য করতে না পেরে ভুল পথে চলে যায়। আবার কেউ কেউ মরিচিকার পেছনে ছুটতে থাকে। জীবনের সঠিক পূর্ণতা উপলব্ধি না করেই। অনেক সন্তান আছে যারা ভালো চাকরি না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে না পেরে নিজের এবং পরিবারের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে জড়িয়ে পড়ে অন্ধকার জগতে। অনেক সময় জীবনকে তুচ্ছ মনে করে প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের মহামূল্যবান জীবনকে নিঃশেষ করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেই চলছে আমাদের চারপাশে। যা কাম্য নয়।

এই সমাজের খুব স্বল্প সংখ্যক অবিভাবক আছেন তাদের সন্তানকে বলে যে, তোমরা সু-শিক্ষিত হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। একজন প্রকৃত মানুষের যা গুণাবলি থাকতে হয়, সেই সব গুণাবলি নিয়ে নিজেকে পরিপূণ্য মানুষ হয়ে জীবনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। প্রশ্নটি সবাই একটু গভীরভাবে ভাবলেই হয়তো সঠিক উপলব্ধিবোধ জাগ্রত হবে।

যে করেই হোক জীবনে বড় হতে হবে, খ্যাতি, অনেক টাকা, দামি গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে হবে এমন চিন্তাধারা যদি ভর করে মাথার ওপর তাহলে দেশ, জাতি বা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনবে না। শুধু নিজের জন্য কিছু করার তাগিদে যে সাফল্য অর্জনের নেশায় মগ্ন থাকে। সেটাতে সাফল্য নিহিত থাকে না। অল্প শিক্ষিত মানুষ হয়েও পৃথিবীর সকল মানুষের মাঝে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। এমন অনেক নজির আছে। আবার উচ্চ শিক্ষিত হয়েও নিজের মেধা, শ্রম ও সততার মাধ্যমে শুধু চাকরি বা বড় কিছু অর্জনের নেশায় না ছুটে হয়েছেন উদ্যোক্তা যেখানে হয়েছেন অনেক মানুষের কর্মসংস্থান। যার মাধ্যমে নিজের খ্যাতি ও সাফল্য দুটোই অর্জন করেছেন। এমন অনেক সাফল্যের গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের চারপাশে।

পক্ষান্তরে একজন কৃষক তার জমিতে ফসল ফলিয়ে সফল, একজন নারী শ্রমিক সেলাইমেশিনে বাহারি রকমের পোশাকে সেলাই করে সফল, রিকশা বা ভ্যানচালক দু’পায়ে প্যাডেল করে সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে কষ্টে অর্জিত আয় থেকে দিন শেষে সামান্য খাবার তার পরিবারের মুখে তুলে দিয়ে নির্মল হাসি ধারা প্রবাহিত করে। সেই মানুষটি সফল। তাদের অনেক টাকা, অনেক খ্যাতির প্রয়োজন হয় না। তাদের স্বচ্ছতার সাথে জীবিকা নির্বাহে তারা স্বস্ব অবস্থান থেকে সফল। এমন সফলতায় গল্পে কোনো অন্যায় পথে আয়-রোজগারের গন্ধ নেই।

আমরা চাইলেই পারি একটি পরিকল্পিত সমাজ ব্যবস্থা গড়তে, যে যার পর্যায় থেকে ভূমিকা রাখতে। ঐ যে দেখুন, একটি সুন্দর ভোর হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই ভোরের অভিযাত্রী হতে পারেন আপনিও। যদি নিজেকে বদলানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন, তবে সেই ভোর হবে পৃথিবীর জন্য একটি সুন্দর আগামী গড়ে তোলার ভোর, সেই ভোর থেকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবীতে থাকবে না কোনো অন্যায়, অত্যাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, খুন, প্রতিহিংসা, লোভ, লালসা, ক্ষমতার দাম্ভিকতা। থাকবে না নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিজের মিথ্যা সাফল্য আর খ্যাতি অর্জনের মগ্নতা। যদি আমরা সবাই নিজেদের সঠিকভাবে, সঠিক পথে পরিচালিত করি স্বচ্ছতার সাথে নিজেদের পাশাপাশি চারপাশের সমাজের মানুষের জন্য, দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য। তাহলে সম্ভব একটি পরিপাটি সুস্থধারার জাতি গঠন করা। প্রতিনিয়িত স্বপ্ন দেখি সেই ভোরের।

লেখক : প্রতিদিনের সংবাদের নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি ও জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সুন্দর ভোর,আমার আমি,প্রজন্ম,সমাজ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close