গোলাম মাওলা শাকিল
যে জীবন পিঁপড়ার
পিঁপড়ারা তিন ভাই বোন। পিঁপড়া, টিপড়া আর শিপড়া। বাবা, মা সহ যমুনা নদীর উওর পাড়ে এক বড় কাঁঠাল গাছের উপর তাদের সুখের সংসার। ভাইবোনগুলোর মধ্যে অসম্ভব মিল। এদের মাঝে ছোটবোন শিপড়া হয়েছে সবচেয়ে সুন্দর, লাল টুকটুকে গায়ের রং।
কিন্তু তাদের সেই সুখের সংসারে কাল হয়ে আসে এবারের বন্যা। দিনে দিনে বন্যার পানি বাড়তেই থাকে। এক গভীর রাতে বাবা পিঁপড়ার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে পিঁপড়ার, ' খোকা ! উঠ জলদি, পানি যেভাবে বাড়তেছে, এখানে আর একমুহূর্ত থাকা চলে না।'
পিঁপড়া গাছের একটু উপরে উঠে বলে _
' বাবা, তোমরা সবাই একটা বড় পাতায় বসে পড়ো, আমি পাতার গোঁড়াতে কেটে দিচ্ছি।'
পিঁপড়া পাতা কাঁটে কুটুস। সবাই পানিতে পড়ে যায়। বাবা পিঁপড়া বলে_ ' খোকা, লাফ দে, তাড়াতাড়ি লাফ দে।'
পিঁপড়া লাফ দেয়, ভাগ্যিস সেই পাতার একদম মাঝেই পড়ে। উত্তাল যমুনার ঢেউয়ে তারা দুলতে থাকে। শুধু মা পিঁপড়ার আফসোস, আহারে কি গুছানো সংসার ছিল !
একেকবার ঢেউয়ে যখন পাতা দুলে উঠে, পিঁপড়া ভাই বোন দু'টোকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
এতো ভয়ের মাঝেও শিপড়ার মনে খুব উত্তেজনা , হঠাৎ সে তার বড় ভাইকে বলে _ ' ভাইয়া, কি ঢেউ দেখছো। আমরা কি ডুবে যাবো? '
পিঁপড়া অভয় দেয়, ধুর পাগলি ! জীবনতো এইরকমই। ঢেউ আসবে, চলে যাবে। শিপড়া আবার বলে, জীবনের সব ঢেউয়ে কি আমরা এইরকম একসাথে থাকবো, ভাইয়া?'
কেনো নয়, আদুরে বোনকে বুকে টেনে নিয়ে পিঁপড়া বলে _ তুই এখন ঘুমা, এতো ঢেউয়ের তোলপাড় নিয়ে তোকে ভাবতে হবেনা। আমি আছি তো পাশেই।'
সারা রাত পাতায় দুলতে দুলতে তারা সকালে যমুনার দক্ষিণে এক মস্ত বড় বাড়ির কোণায় আশ্রয় নেয়।
সবার প্রচণ্ড ক্ষিধাও লাগছে, পিঁপড়া যায় একটু খাবার খুঁজতে। সে বাড়ির রান্নাঘরে গৃহকর্ত্রী চা বানাচ্ছে, পিঁপড়া চিনি সহ চামচে উঠে যায়।
মহিলা চায়ের কাঁপে চামচ দিয়ে পিঁপড়াকে দেখে, বিরক্ত হয়ে ফেলে দেয়। অনেক কষ্টে তিনটা চিনির দানাসহ পিঁপড়া অস্থায়ী ঘরে ফিরে। পোড়া শরীর দেখে বাবা, মা পিঁপড়া আঁতকে উঠে, শরীরে পানি দিতে থাকে আর বিলাপ করতে থাকে, কই গেছলিরে খোকা?'
দুপুরে সে বাড়িতে আবার চা খাওয়ার রেওয়াজ আছে, এবার বের হয় বাবা, মা পিঁপড়া, আর টিপড়া ও শিপড়া। চিনির ঢিব্বা খুলতেই টিপড়া আর শিপড়া ভিতরে ঢুকে যায়, আর বাবা, মা পিঁপড়া কিছু চিনি নিয়ে ঘরে ফিরে।
ঘরে ফিরার পর মনে হয়, ছেলে মেয়ে দুটো বুঝি ঢিব্বার ভিতর আটকে পড়েছে। চিন্তা করতে থাকে তাদের জন্য। ঘরে ফিরে অনেকক্ষণ পর তারা খেতে বসে। আর ঢিব্বার ভিতর এতো চিনির মাঝে টিপড়া, আর শিপড়া আনন্দে গান গায় _
' চিনি আমার চিনি,
সত্যিই এত্তো চিনি।'
বিকেল হয়। পিঁপড়া বলে চলো বাবা _ এখন নিশ্চই তারা চা বানাবে। এই সুযোগে টিপড়া আর শিপড়া কে নিয়ে আসতে হবে।
মা পিঁপড়া আপত্তি করে, এই শরীরে তোকে যেতে হবে না। তবুও পিঁপড়া যায়, বিকেলে সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী চা বানানোর জন্য আবার চিনির ঢিব্বা খুললে তিনজন মিলেই তার পায়ে কামড় দেয়। মহিলা পা হাত দিয়ে ঝাড়া দিতেই চিনির ঢিব্বা মাটিতে পড়ে যায়। বাবা, মা পিঁপড়া অনেক চিনি, টিপড়া আর শিপড়াকে নিয়ে ঘরে চলে আসে। পড়ে যাওয়া চিনি দিয়ে মানুষ কি বা আর করবে ? সেই মহিলা চিনিগুলোও ফেলে দেন।
ধীরেধীরে বাবা পিঁপড়া ঘরে অনেক চিনি মজুদ করে। হঠাৎ তার মনে হয় বড় খোকার কথা। সে কোথায়? উত্তেজনায় অনেকক্ষণ তার খবর পাচ্ছেন না। অসুস্থ শরীরের তার বড় খোকা গেলো কই?
তিনি আবার সেই বাড়ির রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন তার বড় সন্তানের নিথর দেহটা পড়ে আছে। সেই মহিলার হাতের চাপে সে আর বাঁচতে পারে নাই।
দিন যায়। পিঁপড়া পরিবারে আর খাবারের অভাব নাই। নতুন জায়গায় ভালোই সংসার গুছিয়েছেন মা পিঁপড়া। কিন্তু কোথাও যেন সুর নেই। টিপড়া আর শিপড়ার সেই আগের হই হুল্লোর নাই।
মা পিঁপড়া গভীর রাতে কখনো ডুকরিয়ে উঠেন 'ওরে আমার বড় খোকা' বলে। বাবা পিঁপড়া নীরব হয়ে গেছেন, কথাবার্তা তেমন বলেন না। চিৎকার করে কাঁদার চেয়ে নীরবে কাঁদা খুব কঠিন। তিনি সেই কঠিন কাজটাই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
পিডিএসও/ জিজাক