এম এ মাসুদ, গণমাধ্যমকর্মী

  ২০ মার্চ, ২০২১

বই হোক সঙ্গী, বই হোক বন্ধু

মানুষ সকল সৃষ্টির সেরা ও সামাজিক জীব। আর সামাজিক জীব হিসেবে একাকীত্ব চায় না মানুষ। সব সময়েই চায় একে অন্যের সঙ্গ পেতে। চায় ভাবের আদান প্রদান করতে, চায় ভালো সঙ্গী। যিনি বা যারা তাকে দেখাবে সত্য ও সুন্দর পথ, দিক ভ্রষ্ট হলে দিবে সঠিক পথের সন্ধান। অন্ধকারে পা বাড়ালে দেখাবে আলোর পথ। সঙ্গী বা বন্ধু নির্বাচনে ভুল হলে উল্টোটা ঘটবে এটাই তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে বই হতে পারে আমাদের উত্তম বন্ধু বা সঙ্গী। কেননা ভালো বই হলো জ্ঞানের উৎস, যা বিশ্বস্ত বন্ধুর ভূমিকা পালন করে। তাই যুগ যুগ ধরে মানুষ বই পড়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে।

কয়েক দশক আগেও শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সের নরনারীদের অনেককেই দেখা যেত নিজের বা প্রিয়জনকে বই উপহার দেয়ার জন্য পছন্দমতো বই কিনতে বইমেলায় ভিড় জমাতে। কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না বইমেলায় সেই উপচেপড়া ভিড়! ক্রমান্বয়ে যেন ক্রেতাশূন্য বা পাঠক খরায় ভুগছে বইমেলা।

অথচ বই যে কত উত্তম সঙ্গী বা বন্ধু হতে পারে, জগতে তার প্রমাণ রয়েছে ঢের। মার্কাস টুলিয়াস সিসেরোর মতে, ‘বই ছাড়া ঘর একটি আত্মা ছাড়া শরীরের মতো।’ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের তো বলেই দিয়েছেন, ‘বইয়ের মতো এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।’

জগতখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েও নিউটন যেখানে বলেছেন, জ্ঞান সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে, আমি কয়েকটি নুড়ি কুড়িয়েছি মাত্র, সেখানে কয়েকটি সিলেবাসভিত্তিক বই বা সার্টিফিকেট অর্জন করেই মনে হয় জ্ঞানের রাজ্য জয় করে ফেলেছি আমরা! সব কিছুতে অর্থ ব্যয় করতে কার্পণ্য না করলেও কপর্দকহীন হয়ে যাওয়ার ভয়ে হয়তোবা বইকেনা ছেড়েই দিয়েছি অনেকেই!

অথচ বই পড়ায় যাদের আগ্রহ বা নেশা আছে, তারা অন্য খরচ থেকে অর্থ বাঁচিয়ে হলেও মনের তৃষ্ণা বা জ্ঞানের বিস্তারের জন্য কিনেন বই। সৈয়দ মুজতবা আলী তার 'বই কেনা' প্রবন্ধে বলেছেন, ‘প্রকৃত মানুষ জ্ঞানের বাহন পুস্তক জোগাড় করার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে।’

অনেকে আবার শুধু জ্ঞানার্জনের জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে আর ফিরত দেন না, এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মার্ক টোয়েনের বই সংগ্রহ করে লাইব্রেরি তৈরির গল্পটি বলা যেতে পারে। মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরির মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত এবং কার্পেটের ওপরও গাদা গাদা বই স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে এক বন্ধু মার্ক টোয়েনকে বললেন, ‘বইগুলো নষ্ট হচ্ছে, গোটাকয়েক সেলফ জোগাড় করছ না কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরিটা যে কায়দায় গড়ে তুলেছি, সেলফ তো আর সে কায়দায় জোগাড় করতে পারি না। সেলফ তো আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার চাওয়া যায় না।’

ছোটবেলায় আমরা যখন পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও অন্য বই পড়তাম তখন বইয়ের পাতা উল্টিয়ে গুণে গুণে পড়তাম, শেষ না করে যেন স্বস্তি পেতাম না অনেকেই। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বইও কিনতাম দেদারছে। বই এর দোকান ও অমর একুশে বইমেলায় ছিল উপচেপড়া ভিড়। বৃহস্পতিবার অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে যেন বই পড়ার সেই আনন্দের ধবনি প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বই হাতে নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে পড়ার আনন্দই আলাদা। বইয়ের আবেদন মুছে যাবে না।'

বিভিন্ন সমস্যা, নিত্যদিনের অবসাদ, মানসিক দুশ্চিন্তা উত্তরণে বই দিতে পারে সীমাহীন আনন্দ। বই-ই পারে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করতে। চলার পথে বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের জীবনী , বরেণ্য লেখকদের লেখা ধর্মীয় ও জ্ঞানবিজ্ঞানের মূল্যবান বই আমাদের কল্যাণময় দিক নির্দেশনা দেয়। শিল্প-সাহিত্য চর্চা আমাদের সুকুমার প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করে বাড়িয়ে দেয় জ্ঞানের পরিধি, করে মনের দিগন্ত উন্মোচিত। কুসংস্কার থেকে মুক্ত রেখে প্রকৃত মানুষ হতে শেখায় ভালো বই।

নবম-দশম শ্রেণির ইসলাম শিক্ষায় একটি হাদিস পড়েছিলাম, 'প্রত্যেক নরনারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। আর এই জ্ঞান পাবো আমরা ভালো বই থেকে।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-সহ জগতখ্যাত মহামনীষীদের জীবনী জানতে হলেও বই অপরিহার্য। কোন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে একমাত্র বই। নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হতে পারে বই। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তবে যার ভালবাসা নেই, তিনি নিশ্চয়ই ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ।

সুতরাং অমর একুশে বইমেলা হয়ে উঠুক প্রাণবন্ত, প্রতিটি ঘর হোক একেকটি লাইব্রেরি, বই হোক আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, হোক উত্তম বন্ধু। সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রতিদিনের সংবাদের সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বই,বইমেলা,জ্ঞান
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close