এম এ মাসুদ, সংবাদিক

  ২১ জানুয়ারি, ২০২১

জন্মদিনে বাবার চিঠি

আমরা প্রবেশ করেছি অনেক আগেই ইন্টারনেটের যুগে। মুহুর্তেই যোগাযোগ করতে পাচ্ছি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ব্যবহার করছি স্মার্ট ফোন। কথা হচ্ছে ফোনে, লিখছি ই-মেইল, মেসেঞ্জার, ইমোতে। শুধুই কি লেখা! দেখাও হচ্ছে, ওই মাধ্যমগুলো দিয়ে। কিন্তু বেশি দিন আগের কথা নয়, প্রায় দেড়যুগ আগেও আমাদের যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ মাধ্যম ছিল চিঠি। সেই সময়ে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত না থাকার কারণে দূরত্ব ১০/২০ মাইল হলেও পরিবারের আপনজন, আত্নীয় বা অন্য কারো সাথে যোগাযোগ রক্ষা হতো চিঠি আদান প্রদান করে। আর ডাকবিভাগ পালন করতো সেই দায়িত্ব। ওই চিঠির জন্য বাবা-মা অপেক্ষার প্রহর গুণতেন তাদের প্রিয় সন্তানের জন্য, স্ত্রী অপেক্ষা করতো স্বামীর জন্য, সন্তান তার বাবার জন্য, প্রেমিক-প্রেমিকা অপেক্ষা করতো তার মনের প্রিয় মানুষটির জন্য। অনেককেই দেখা যেত ডাকঘরে চিঠির বক্সে চিঠি ফেলতে। আবার অনেকেই ডাকঘর বা রানারের কাছে খোঁজ নিতেন প্রিয়জনের চিঠি এসেছে কি না। লিখতে ব্যবহার হতো বাহারি রঙের কাগজ ও খাম। প্রিয়জনের চিঠি পড়তো বারবার।

আজ প্রযুক্তির কল্যাণে নেই সেই অপেক্ষার পালা। ক্রমান্বয়ে আমরা হয়ে পড়ছি যান্ত্রিক। কেন জানি মনে হয় ফিকে হয়ে যাচ্ছে স্নেহ, ভালবাসা ও আন্তরিকতা। কোথায় যেন একটা ঘাটতি!

নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো চিঠি এক অজানা বিষয়। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি দেখেছি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেককেই ব্যক্তিগত চিঠি বাবা, মা, ছোট বা বড় ভাই বোনদের কাছে বা অন্য কারো নিকট কিভাবে লিখতে হয় তা লিখতে হিমসিম খেতে। দূরে সরে যাচ্ছি শ্রদ্ধেয়, শ্রীচরণেষু, পূজনীয়, প্রিয়তম, প্রিয়তমা, ইতি, স্নেহের মতো শব্দগুলোর ব্যবহার থেকে । দেখা যায়না 'চিঠি পাওয়া মাত্রই উত্তর দিবে', পৌঁছেই চিঠি দিবে, লেখা হয়না 'চিঠি দিও প্রতিদিন'র মতো বিভিন্ন গান। বাংলা সাহিত্যে চিঠিকে কেন্দ্র করে লেখা হয় না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ যা চিঠির মতো লেখা। অজ পাড়া গাঁয়ের পোস্ট অফিসের ঘটনাবলী নিয়ে আরেক ছোট গল্প ‘পোস্টমাস্টার’, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘ডাকহরকরা’, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতার মতো লেখা।

আর প্রযুক্তির এ যুগে যদি বাবা তার সন্তানের জন্মদিনে চিঠি লিখেন, তবে সেই চিঠি দেখে চোখ কপালে উঠবে বৈকি! ঠিক তেমনি একটি চিঠি আমি দেখেছি কয়েকদিন আগে। সন্তানের প্রতি বাবার লেখা ওই চিঠি দেখেই কেন জানি মনে হলো চিঠি সম্পর্কে লিখতে। জন্মদিনে বাবার দেয়া সেই চিঠির ভাষা ছিল এমন-

সোনা বাবা,

শুভ জন্মদিন। ২০০০ সালের ঠিক এই দিনে তোমার জন্ম হয়েছিল। হাঁটি হাঁট পা পা করে আজ বেশ বড় হয়েছ। ভাল মন্দ সব বুঝতে পাচ্ছ। আমার ঘাম ঝরানো হালাল উপার্জন দিয়ে কষ্ট করে হলেও তোমাদের দু'ভাইকে চেষ্টা করছি প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। তোমার আম্মু আর আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি, তুমি পড়ালেখা করে একদিন একজন আদর্শবান মানুষ হবে। আমাদের সেই স্বপ্ন পুরণ করতে তুমি দিবানিশি করছো পরিশ্রম। পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে তুমি বেয়ে উঠছো সেই সিঁড়ি। আমাদের বিশ্বাস, আল্লাহ তোমাকে পৌঁছে দিবেন সেই মঞ্জিলে। মন্দকে অনুসরণ না করে অনুসরণ করবে ভালোকে। যারা তোমাকে কোন কাজ বা কথায় কষ্ট দিবে তাদের প্রতি হবে সদয়। কোন কথায় বা আচরণে কাউকে কষ্ট দিওনা। 'অর্থ অনর্থের মূল' এটি ভুলে যেওনা। মনে রাখবে, তুমি হবে মানুষের সেবক, করবে দায়িত্বশীল আচরণ। প্রতিবেশিদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবে। সততাকে কখনো বিসর্জন দিওনা। কারণে অকারণে মিথ্যে বলা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের স্বপ্ন পুরণে আল্লাহ হয়তো তোমাকে সেদিকেই ধাবিত করছেন।

পরিশেষে দোওয়া করি জীবনে সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ হয়ে অনেক বড় মানের মানুষ হবে সেটিই মোদের প্রত্যাশা। আল্লাহ তোমাকে তোমার সেই অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে দিন।

ইতি,

তোমার

আব্বু, আম্মু।

আধুনিক যুগে সন্তানের সাথে এতোগুলো কথা বলার সুযোগ কই! ওই হাই আর হ্যালোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু সময় নিয়ে চিঠি লেখার আমরা সেই পুরনো অভ্যাস রপ্ত করতে পারবো কি?

পিডিএসও/ জিজাক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চিঠি,সন্তান,জন্মদিন,আমার আমি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close