এম এ মাসুদ, সাংবাদিক

  ০৫ জানুয়ারি, ২০২১

হারিয়ে যাওয়া সোনালি অতীত

কালের আবর্তে প্রতিটি ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে পরিবর্তন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে ঘর বাড়ি, কৃষি, বিদ্যুৎ, যাতায়াত, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমাসহ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ফলশ্রুতিতে ক্রমান্বয়ে আমরা হারিয়ে ফেলছি সেই সোনালি অতীত। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না আমাদের সমৃদ্ধ অতীত সম্পর্কে। আর এই না-জানার কারণে হাল চাষ, গরুর গাড়ি, মারা, রেডিও, সাদাকালো টেলিভিশন, সাদাকালো সিনেমার কথা শুনলে তাদের কাছে রূপকথার গল্প বলে মনে হয়। তারা মানতেই চায় না যে, সেই দিনগুলো ছিল অনেক মধুর। ছিল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের। নতুন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাওয়া সেই সোনালি অতীত তুলে ধরতেই আজকের এ লেখা।

কুঁড়েঘর : ছোটবেলায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কুটির কবিতায় পড়েছিলাম‘ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর, ওইখানে আমাদের পাতার কুটির/কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন, নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।’ কি দারুণ সেই কবিতা। গ্রাম বাংলায় গরম ও শীতকালের এসি (এয়ার কন্ডিশন) হিসেবে পরিচিত কুঁড়েঘর। দশক দুয়েক আগেও এমন বাড়ি খুব কম পাওয়া যেত, যে বাড়িতে কুঁড়েঘর ছিল না। কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন, প্রদর্শন প্রভাব কার্যকর এবং খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় কুঁড়েঘর বিলুপ্ত হয়েছে। এখন স্থিরচিত্র ধারণ করার জন্যও কুঁড়েঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার বদলে স্থান দখল করেছে টিনের বা পাকা ঘর। আর হারিয়েছি আমাদের গ্রাম বাংলার এ ঐতিহ্য।

বাতি (কুপি) : অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ওই ‘কুটির’ কবিতায় বাতি বা পিদিম নিয়ে লিখেছেন—‘দু কদম হেঁটে এসো মোদের কুটির, পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির/বেলা যে পড়িয়া এল, গায়ে লাগে হিম/আকাশে সাঁঝের তারা, উঠানে পিদিম।’ কি চমৎকার কথা!

এই তো দু'দশক আগেও গ্রাম বাংলার প্রতিটি বাড়ি বা ঘরে জ্বলতো কেরোসিনের বাতি বা পিদিম। রাতের আঁধারে অন্ধকার দূর করতে যা ব্যবহৃত হতো। গ্রামাঞ্চলের ধনী-গরিব সবাই জ্বালাতেন সেই বাতি। আবার স্বচ্ছলতা থাকলে তাদের ঘরে থাকত হ্যারিকেন। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, গৃহিণীদের রান্নার সময় বাতিই ছিল অন্ধকার দূর করার একমাত্র উপায়। জন্মহার বৃদ্ধির কারণে সন্তান সংখ্যা ছিল বেশি। কয়েক ভাইবোন মিলে রাতে পড়াশোনা করতো একটি বা দুটি বাতির মিটিমিটি আলোয়। রান্নার সময় চুলার পাশে পাটিতে বসে দাদি-নানিরা তাদের নাতি-নাতনিদের নিয়ে বলতো মজার মজার গল্প। রান্না শেষে রাতের আহার করতো সবাই মিলে একই সাথে ওই বাতির আলোয়। যদিও সময়ের পরিবর্তনে সেই বাতির জায়গায় স্থান দখল করেছে বৈদ্যুতিক বাতি, সোলার প্যানেল, আলোকিত হয়ে উঠেছে ঘর -ড়ি, কিন্তু সেই দিনগুলো যে ছিল অনেক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

হাল : আবহমানকাল থেকেই গ্রামীণ জনপদে জমি চাষ করার প্রধান মাধ্যম ছিল হাল। আর হাল দিয়ে জমি চাষ করার জন্য প্রয়োজন ছিল গরু বা মহিষ। যে সমস্ত কৃষকের একটি বা দুটি হাল ছিল তারা পাড়া বা গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের সাথে মিলে গাতা (পালাক্রমে) করে জমি চাষ করতেন। গাইতেন বিভিন্ন আঞ্চলিক গান, করতেন আনন্দ। দিতেন বেগারী (বিনামূল্যে হাল), করতেন একসাথে আহার। কিন্তু আধুনিক কৃষিতে হালের জায়গায় স্থান দখল করে নিয়েছে কলের লাঙল। ফলে দেখা যায় না আর গরু বা মহিষের হাল, মাঠে শোনা যায় না কৃষকের মুখে সেই গান‘বাড়ির পাশে বেতের আড়া, হাল জুড়ছে মোর ছোট দেওরা’।

গরুর গাড়ি : গ্রাম বাংলায় এক সময়ে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল গরুর গাড়ি। প্রায় দশক তিনেক আগেও যার প্রচলন ছিল। বিয়ে, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যেতে যানবাহনের তালিকায় প্রথম স্থানে ছিল গরুর গাড়ি। মালামাল পরিবহনেও ছিল যার আধিপত্য। সারিবদ্ধভাবে যেত দশ, বিশ, পঞ্চাশ মাইল, আর মনের আনন্দে গাইতো—‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দর’ গানসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক গান। রাস্তাঘাট পাকা ও যান্ত্রিক উন্নয়নের ফলে কালের আবর্তে আজ হারিয়ে গেছে সেই গরুর গাড়ি। তরুণ, তরুণী, এমনকি যুবক-যুবতীদের মধ্যে অনেকেই দেখেনি গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ির কথা শুনলে এখন তাদের চোখ কপালে ওঠে, হাসে।

রেডিও : রেডিও ছিল একসময়ে শিক্ষা, বিনোদন বা খবর শোনার অন্যতম মাধ্যম। বছর ত্রিশেক আগেও কৃষকরা রেডিও নিয়ে যেত মাঠে, জামাই তার স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যেত শ্বশুর বাড়িতে আর শুনতো গান। অনুরোধের আসর, সৈনিকদের জন্য দুর্বার অনুষ্ঠানে হতো সিনেমার গান, হতো বিভিন্ন আঞ্চলিক পালা গানের আসর, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, নাটকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর মানুষ দলবদ্ধভাবে বসে বসে তা শুনতো। কি সৌহার্দ্যই না ছিল তাদের মাঝে! সেই রেডিও এখন নতুনদের কাছে এক অজানা বিষয়।

সাদাকালো সিনেমা : নব্বই দশকের আগে সিনেমা ছিল মানুষের কাছে অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম। বাবা, মা, ভাই, বোনসহ সপরিবারে ঘটা করে যেতেন সিনেমা হলে। বিনোদনের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নির্মিত সিনেমা দেখে যেমন আনন্দ পেতেন, তেমনি অনেকেই আবার কেঁদেও ফেলতেন। সিনেমার গান ঘুরতো সবার মুখে মুখে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সিনেমা রঙিন হয়েছে বটে কিন্তু নেই সেই মান। অশ্লীলতা মানুষকে সিনেমা হল বিমুখ করেছে। বঞ্চিত হয়েছে মানুষ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিনোদনের অন্যতম এক মাধ্যম থেকে।

এগুলো হারিয়ে যাওয়ায় এখন আর তেমন মিল নেই সমাজের মানুষের মাঝে। নিজ এবং নিজের পরিবার নিয়ে কেন জানি ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়ছি আমরা আত্মকেন্দ্রিক।

মধ্যবয়সীদের সাথে এসব বিষয়ে কথা উঠলে তারা করেন স্মৃতিচারণ, প্রকাশ করেন আপসোস। শুধু স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া আর কি-ই-বা করার আছে তাদের!

লেখক : প্রতিদিনের সংবাদের সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সোনালি অতীত,বাতি,রেডিও,গরুর গাড়ি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close