মনসুর হেলাল

  ০৫ অক্টোবর, ২০২০

দিঘির নাম ধর্মসাগর

ধর্মসাগর দিঘি

ধর্মসাগর মূলত একটি প্রাচীন দিঘি। ট্যাঙ্ক ও ব্যাংকের নগরীখ্যাত কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্রে তার অবস্থান। আমরা অনেকেই জানি, কুমিল্লা একটি প্রাচীন জনপদ। এখানে ছিল অনেক রাজ-রাজরাদের রাজত্ব। তাদের অনেকেই ছিল শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। আবার কেউ কেউ গড়েছেন সৌকর্যময় প্রাসাদ, মন্দির ও বিহার। কেউ কেউ প্রজাদের জন্য গড়েছেন অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা আশ্রয় কেন্দ্র। এমনকি খনন করেছেন বিশাল বিশাল দিঘি। ঠিক ধর্মসাগরও এরকমই একটি খননকৃত দিঘি। আজ থেকে প্রায় পৌনে ৬০০ বছর আগে ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজা প্রথম ধর্মমাণিক্য এই দিঘিটি খনন করেন। এবং তারই নামানুসারে দিঘিটির নামকরণ করা হয় ‘ধর্মসাগর’।

ধর্মসাগর নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক উপাখ্যান ও উপকথা। তবে ঐতিহাসিক ‘রাজমালা’ গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী মহারাজা ধর্মমাণিক্য ১৪৩১-১৪৬২ খ্রি. পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩২ বছর ত্রিপুরার অধিপতি ছিলেন। একজন প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে তার ছিল যথেষ্ট সুনাম। তার স্থাপিত অনেক কীর্তি সেই সুশাসনের ইঙ্গিত বহন করছে। কুমিল্লা ও তার আশেপাশের অনেক অঞ্চল ছিল ধর্মমাণিক্যের রাজত্বের অধীন। ফলে সেখানে রয়েছে তার অনেক স্মৃতি। এর মধ্যে প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি দিঘি খনন করেন। অপার সৌন্দর্যের বিশাল ধর্মসাগর সেসব দিঘিগুলোর একটি। ১৫০০ শ্রমিকের ৭৩০ দিনের শ্রমে গড়া এই দিঘির আয়তন ২৩.১৮ একর। দেশ বিভক্তির পর ১৯৬৪ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দিঘিটির পশ্চিম ও উত্তর পাড়টি পাঁকা করা হয়। শুধু তাই নয়, এর পরেও দিঘিটি বেশ কয়েকবারই সংস্কার করা হয়। বর্তমানে দিঘিটি দেশের মৎস্য বিভাগের তত্ত্ববধানে রয়েছে ।

ধর্মসাগরের পূর্ব প্রান্তে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ষ্টেডিয়াম ও কুমিল্লা জিলা স্কুল, দক্ষিণে কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয় ও খ্রিস্টানদের চার্চ। উত্তর দিকে রানীর কুঠির, নজরুল ইনস্টিটিউট, নগর শিশু উদ্যান, কুমিল্লা আর্ট কলেজ ও জেলা প্রশাসকের অফিস। এছাড়া ধর্মসাগরের চারপাশে রয়েছে সবুজ বৃক্ষের ব্যাপক সমাহার। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাখপাখালির কলতানে সর্বদা মুখর থাকে ধর্মসাগরের শ্যামল আঙ্গিনা। তাই বছর ধরেই দূর-দূরান্ত থেকে এ দিঘি দেখার জন্য আসেন অসংখ্য পর্যটক, প্রকৃতি ও বিনোদনপ্রেমীরা। দিঘির উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ৫ একরের ‘নগর উদ্যান’। এটির তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। তাদের উদ্যোগে এখানে স্থাপন করা হয়েছে বিনোদনের নানা উপকরণ। নানা প্রজাতির মৌসুমী ফুল ও অরণ্যে ঘেরা অসংখ্য সবুজ বৃক্ষ ধর্মসাগরকে দিয়েছে এক নৈসর্গিক শোভা। তাছাড়া শীত মৌসুমে ধর্মসাগরে প্রচুর পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। তাদের কিচির-মিচির শব্দে ধর্মসাগরের থৈথৈ জলতরঙ্গে ছন্দায়িত হয় নতুন প্রাণের উচ্ছাস।

ধর্মসাগর ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একটি উৎকৃষ্ট স্থান। যাকে ঘিরে মানুষের মিলনমেলা পরিণত হয় সকাল বিকাল। এখানে সকালে আসেন যারা স্বাস্থ্য সচেতন ও ডায়াবেটিস রোগী কিংবা যারা শরীরকে সব সময় সুন্দর রাখতে চান তারা। অন্যদিকে, সবুজ ছায়ায় আচ্ছাদিত ও কোলাহল মুক্ত এই স্থানটিতে অনেকে আসেন সামান্য প্রশান্তির জন্য। ধর্মসাগরে এলে নাগরিক জীবনের যাবতীয় ক্লান্তি ও যন্ত্রণা মুছে যায় মুহূর্তেই। যতই বেলা বাডতে থাকে ততই মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। চাইলে নৌকা ভাড়া নিয়ে দিঘির চারপাশে ঘুরে আসা যায়। বলতে গেলে, মনোরঞ্জন কিংবা অবসরে বিনোদনের সঙ্গে সময় কাটানোর এক দর্শনীয় স্থান ধর্মসাগর।

ধর্মসাগর কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিধায় যে কোনো স্থান থেকে এখানে সহজে যাতায়াত করা যায়। আর সে কারণে প্রতিদিনই বহু লোকের সমাগম ঘটে। বিশেষ বিশেষ দিনে দর্শনার্থীদের এত ভিড় থাকে যে তখন পা ফেলতেই কষ্ট হয়। বিশেষ দিনগুলোতে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যাই থাকে বেশি। তরুণরা গিটার নিয়ে গানে গানে মেতে উঠে, আর তরুণীরা সেই সুরে থাকে মত্ত। অন্যদিকে অনবরত চলতে থাকে ফটোপ্রেমীদের ক্যামেরার ক্লিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মসাগরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে। সেই সুবাদে এর আশপাশেরও বেশ উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। সকালের রোদমাখা জাদুকরী আলোয় ভেসে যায় এর সবুজ তরঙ্গ। আর সন্ধ্যায় মায়াবী আলোয় ভরে উঠে এর চারপাশ। যা দর্শনার্থীদের অনুভবে দেয় ভালোলাগার এক অপূর্ব শিহরণ। প্রসঙ্গত, ধর্মসাগর ছাড়াও কুমিল্লায় আছে ছোট-বড় অনেক ঐতিহ্যবাহী দিঘি। এগুলোর মধ্যে নগরীর ভেতরে ‘নানুয়ার দিঘি’, ‘উজির দিঘি’, ‘লাউয়া দিঘি’, ‘রানীর দিঘি’, ‘বলিনাথ দিঘি’, সেনানিবাস এলাকায় ‘আনন্দ রাজার দিঘি’, ‘ভোজ রাজার দিঘি’, বরুড়ায় ‘কৃষ্ণসাগর দিঘি’, ‘কাজির দিঘি’, সদর দক্ষিণে ‘দুতিয়ার দিঘি’, চৌদ্দগ্রামে ‘জগন্নাথ দিঘি’, ‘শিবের দিঘি’ ও মনোহরগঞ্জে বিশাল আয়তনের ‘নাটেশ্বর দিঘি’ উল্লেখযোগ্য। তবে এসব দিঘির মধ্যে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ধর্মসাগরই সেরা ও অত্যন্ত প্রিয় একটি গন্তব্যস্থান। দেশে-বিদেশে এই দিঘির রয়েছে অনেক সুখ্যাতি। ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ কুমিল্লার গর্ব ধর্মসাগর। সময় সুযোগ মতো যে কেউ দেখে আসতে পারেন এর অপরূপ শোভা।

পিডিএসও/ জিজাক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধর্মসাগর,দিঘি,কুমিল্লা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close