reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৪ আগস্ট, ২০২০

করোনা ও প্রাথমিক শিক্ষা : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি'র) ৪ নম্বর লক্ষ্য হলো, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি শিশুর মানসম্মত শিক্ষা সুনিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যতটুকু এগিয়েছিলো বাংলাদেশ, সাম্প্রতিক সময়ের করোনা মহামারি সেটিকে অনেকাংশেই ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। মহামারির এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাসের সুফল-কুফল নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা ছিলো অপ্রতুল। অথচ একটি দেশের শিক্ষার মূল ভিত্তি তৈরি হয় প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে। করোনাকালীন সময়ে নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন। আর সামগ্রিক অর্থনীতির এমন ভঙ্গুর অবস্থায় যেখানে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়', সেখানে সন্তানদের পড়াশোনা চালু রাখা রীতিমত বিলাসিতা। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি গরীব মানুষের বসবাস। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মতে করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশে প্রায় ১.৫ কোটি লোক বর্তমান চাকরি হারাবে। আর দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) এক গবেষণায় দেখা গেছে করোনা পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্যতার হার বাড়বে ৩৫%। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে মানুষজন যেখানে চাকরি হারাচ্ছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ করছে ও দিনমজুর সহ অন্যান্য নিম্নবিত্ত শ্রেণির জনগণ কাজের অভাবে ভুগছে সেখানে তাদের সন্তানদের শিক্ষা কার্যক্রম চালানো অনেকটা অসম্ভব। আকস্মিক আর্থিক বেসামাল অবস্থা সামাল দিতেই পরিবারের অনেক স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা উপার্জনের আশায় পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যোগ দিবে। ব্রাক ইন্সটিটউট অব গভর্নেন্সের মতে, ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় ২০% শিক্ষার্থী পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্যে করতে বিভিন্ন কাজে জড়িয়েছে।

বৈশ্বিকভাবেও ব্যপক আলোচনা হচ্ছে প্রাথমিক স্তরের স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার নিয়ে। 'দ্যা ব্রিটিশ চ্যারেটির' রিপোর্ট অনুযায়ী করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের প্রায় এক কোটি (৯৭ লক্ষ) শিক্ষার্থী স্কুলে পুনরায় যাবেনা । শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান 'সেভ দ্যা চিলড্রেন' এর সমীক্ষাও বলছে একই কথা। তাদের মতে সমগ্র বিশ্বে করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে স্কুলগামী প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী করোনা পরবর্তী সময়ে স্কুলে ফিরবেনা। তারা ২৮টি দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারের ক্ষেত্রে, উল্লেখ্য যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা 'খ্রিষ্টান অ্যাড' বলছে, করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বে অসমতা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের স্কুলগামী মেয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় যোগ না দিতে পেরে বাল্য বিবাহের শিকার হবে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও গ্লোবাল পার্টনারশিপ অব এডুকেশনের চেয়ার জুলিয়ান গিলার্ড বলেছেন, মহামারির পর পর সবচাইতে বেশি পিছিয়ে পড়ে স্কুলগামী মেয়েরা। ইবোলা মহামারির সময় সিয়েরা লিওনে হাজারো মেয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে যাদের বেশিরভাগ বাল্যবিবাহের শিকার, কেউ কম বয়সে হয়েছে অন্তঃসত্তা, কেউ কেউ পরিবারকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়ে কাজ করতে নেমেছে।

করোনা পরবর্তী সময়ের উচ্চশিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস নিয়ে ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, সামনেও হবে। আর করোনা পরবর্তী নতুন স্বাভাবিক সময়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার প্রতিরোধ করে কিভাবে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠা যায়, তা এখনই ভাবতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের তহবিল হতে ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি পাচ্ছে, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত না। ২০১১ সালে বাংলাদেশে মিড ডে মিল বা বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হতো। মূলত শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমানোর জন্যই প্রকল্পটি চালু করা হয়। প্রকল্প চালুর মাত্র ছয় মাস পর সেই কার্যক্রম বন্ধ হবার আগে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিলো রেকর্ড ৯০%। যদিও গতবছর বাংলাদেশ সরকার মিড ডে মিল চালুর লক্ষ্যে 'জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯' খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমানোর লক্ষ্যে এই ধরণের প্রকল্পগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যকীয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি, প্রাথমিক শিক্ষা স্তর আগের মত সচল রাখতে তৈরি করা যেতে পারে বিশেষ আর্থিক সাহায্যের ফান্ড। শুধু তাই নয়, স্কুলের পক্ষ থেকেও পর্যাপ্ত নজরদারি রাখতে হবে যাতে একজন শিক্ষার্থীও ঝরে না পড়ে। অন্যথায় একটি প্রজন্মের বৃহৎ অংশ অকালে ঝরে যাবে শিশুশ্রম অথবা বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে ।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড আর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা জাতিগঠনের মূল ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত সর্বপরি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা অকালে ঝরে পড়লে সামগ্রিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ, তাই নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সচেতন হতে হবে এই মুহূর্ত থেকেই ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনা,প্রাথমিক শিক্ষা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close