নিজাম উদ্দীন (স্বাধীন)

  ২০ জুলাই, ২০২০

প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ

কর্মের চরণে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য আজ যারা প্রবাসী। আর প্রবাসজীবনে তাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু।

সুজালা সফলা শস্য-শ্যামলা সবুজেঘেরা সোনার বাংলা এই আমাদের মাতৃভূমি। মা-বাবা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের প্রিয় স্ত্রীর মায়া-মমতা ভালোবাসা ত্যাগ করে, সংসারের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, আর্থিক উন্নতির জন্যই প্রবাসের মাটিতে তারা হয় প্রবাসী।

তারা শুধু অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনা বা ভ্রমণ কাহিনি দেখার জন্য নয়। জীবন জীবিকার তাগিদে, সোনালি স্বপ্নের হাতছানিতে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে। নিজের দেশ, নিজের জন্মভূমি নিজের দেশের মাটি আর প্রবাসজীবনের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান।

যারা বিভিন্ন দেশ বিমানে যাতায়াত করে। দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং অথবা থাইল্যান্ড এয়ার পোর্টে ট্রানজিট নিতে হয়। মালয়েশিয়া এবং দুবাই এয়ারপোর্টে প্রবাস ফেরত শ্রমিক ভাইদের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। তাদের কাছে একে-অপরে তাদের সুখ-দুঃখের গল্প বলে। কেউ বলে সেই উত্তপ্তময় মরুভূমির কথা, কেউ বলে নির্যাতন আর নি:স্ব হয়ে দেশে ফেরার কথা। একে-অপরের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

প্রবাসজীবন মানে নিষ্ঠুর, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্য থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে দেয়ালবিহীন এক কারাগার। কারও দুঃখ কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না। নিজের দুঃখ নিজে অন্তরে রেখে নীরবে কান্না করতে হয় তাদের। প্রবাসে যারা গিয়েছে, তারাই একমাত্র প্রবাসজীবন যে কত নির্দয় ও নির্মম, তার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

প্রবাসে গিয়ে চাকরি করে অনেক টাকাপয়সা রোজগার করে দেশে পাঠায়। দুঃখের অন্ধকারের থেকে আসবে সুখের আলো। এই সোনালি স্বপ্নের প্রত্যাশা বুকে নিয়ে প্রবাসে গিয়েছে অনেকে। কিন্তু তাদের সেই সুখ, সেই সুখের স্বপ্ন সবাই কি পূরণ করতে পেরেছে?

বেশির ভাগ প্রবাসীই তাদের আশা-আকাঙ্খা এবং তাদের যে উদ্দেশ্যে প্রবাসে আসা, তা পূরণ করতে সক্ষম হয় না। কারও মালিক ঠিকমতো বেতন দিচ্ছে না, আবার কেউ দেশ থেকে যে বেতনের কথা শুনে গিয়েছিল, তারা দেখতে পেল সেই বেতনের সঙ্গে কোনো মিল নেই। আবার সঠিক বেতন পেলেও সে বেতন নিয়মিত নয়।

সবাই যে খারাপ অবস্থায় আছেন তা কিন্তু নয়। অনেক বাংলাদেশি ভাই আছেন তারা ভাল পদে চাকরি করে বেশি বেতন পাচ্ছেন। তাদের পরিবার-পরিজন সুন্দরভাবে দিনযাপন করছেন।

তাই অনুরোধ, যারা মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়ায় চাকরির জন্য নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করার চিন্তাভাবনা করছেন, তারা যেন একটু যাচাই-বাছাই করে ভিসা এবং কন্ট্রাক্ট ফর্ম দেখে বিদেশে পাড়ি জমান। আর দেশে যদি কোনো ভালো চাকরি করা যায় তবে তাই করা উচিত।

প্রবাসীরা যখন দেশে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তখন কেমন আছিস, কোনো চিন্তা করিস না, আমরা ভালো আছি, বাড়ির সবাই ভালো আছে, কোনো সমস্যা অথবা সমস্যার সমাধান, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে কিনা এই বিষয়গুলোই বলেন। কেউ কেউ আবার, ঝগড়া করে, তর্ক করে, নালিশ করে।

দেশ থেকে যারা প্রবাসীকে ফোন করেন বিশেষ করে যাদের প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা নেই, তারা একজন প্রবাসীর মনের অবস্থা, তার একাকিত্ব, তার আবেগ, তার কষ্ট, তার উদাসীনতা, তার নীরব কান্না এগুলো বুঝতে পারেন না। এই অনুভূতিগুলো অনুভব করাও তাদের পক্ষে সম্ভবও না। প্রবাসীজীবনে প্রবাসীরাই এইগুলো বেশি অনুভব করেন।

প্রবাসীদের মনে অনেক কষ্ট। কারণ তাদের মা-বাবা, ভাইবোন স্ত্রী, সবাইকে ছেড়ে বন্দিজীবন কাটায়। ভোর ৪টায় উঠে কাজে যেতে হয় আর ফিরতে হয় সেই রাতে। কাজের চাপে প্রতিদিন পাক করা সম্ভব হয় না। তাই দুই তিন দিনের আগের পাক করা খাবার দুপুরে জন্য পলিথিন ব্যাগে করে নিয়ে যেতে হয় কাজের জায়গায়। ফ্রিজ না থাকার কারণে কখনো ভালো থাকে আবার কখনো বা খাবার নষ্ট হয়ে যায়।

প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শুনেও কিছু করার থাকে না তাদের। এমন হতভাগ্য তারা। যখন কেউ একটু অসুস্থ হয় তখন পাশে কেউ থাকে না সেবা করার। অসুস্থকে রেখে সবাই চলে যায় সবার কাজে। কারও একটু সময় নাই তার পাশে থাকার।

হায়রে প্রবাস তাদের জীবন। এই প্রবাসে গিয়ে কত আপন মানুষ হয়ে গেল পর। কতদিন চলে গেল, বোনের ভাইয়া ডাক শুনতে পায় না তারা। মা বলে না, আয় খোকা আমি নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দেবো। কতদিন, আর কতদিন এভাবে কাটাবে তারা প্রবাসজীবন? কবে এই দাসত্ব থেকে মুক্ত হবে প্রবাসীরা

তারপরও প্রবাসীরা চায় তাদের প্রিয়জনের মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলতে। রাত যায়, দিন যায়, পড়ে থাকে একা। রোজা যায়, ঈদ যায়, যায় কত সুখের দিন, দেশের মানুষ কত আনন্দ করে, তারা তা দেখে প্রতিদিন। তবু প্রবাসীরা অনেক সুখ পায়, যখন শুনতে পায় আমরা ভাল আছি, সুখে আছি।

তবে সবার কাছে অনুরোধ, যারা দেশে আছেন আর বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন অথবা পুত্র-কন্যা কিংবা স্বামী-স্ত্রী যেই প্রবাসী হোক না কেন, সব কিছুর মধ্য দিয়ে প্রবাসীদের সেই কষ্ট, অনভূতি, বেদনা, নীরব কান্না একটু বোঝার চেষ্টা করবেন।

তাদেরকে যতখানি সম্ভব একাকিত্ব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবেন। তাদেরকে যতখানি সম্ভব নিজেদের কাছে রাখার চেষ্টা করবেন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, আপনার একটু সহানুভূতি একজন প্রবাসীর জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলবে। তার প্রবাসজীবন কতখানি আনন্দময় হয়ে উঠবে।

তারা তো একটু সুখের আশায় পাড়ি দিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। তাদের দুটি চোখ এক চিলতে সুখ দেখার জন্য অপলকে চেয়ে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। দুঃখ নিয়ে বিলাসিতা করার সুযোগ নেই তাদের।

দুঃখ নিবারণ করার ইচ্ছা নিয়ে মা-মাটি ছেড়ে অজানা-অচেনা এক দেশের মাটিতে আশার ঘর বেঁধেছে। প্রবাসীরা দুঃখবিলাসী নয়, তারা সুখের কাঙাল। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুখ খুঁজে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায় পরদেশের এপার-ওপার। কত কিছুই না করে, সবকিছু তো লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। বিদেশের মাটিতে কত প্রবাসী মৃত্যুবরণ করছে, স্বজনরাও তাদের শেষ বিদায় জানাতে পারে না।

লেখক : উপজেলা প্রতিনিধি, বেতাগী (বরগুনা)

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সুখ-দুঃখ,প্রবাসী,প্রবাসজীবন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close