শ্রীধর দত্ত, প্রবাসী লেখক

  ২৭ আগস্ট, ২০১৯

পদ্মপূরাণে বেহুলা-লক্ষিন্দরের অমর কাহিনী

হিন্দু শাস্ত্রে আঠারটি পুরাণ রয়েছে। পদ্মপুরাণ হচ্ছে তৎমধ্যে একটি। এই পুরাণের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা। মনসা হচ্ছে শিবের কন্যা। সমুদ্র মন্থনের সময় শিব বিষ পান করেছিলেন এবং সেই বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত করেছিলেন মা মনসা। এরপর থেকে মনসাকে বিষহরিও বলা হয়। পদ্মপুরাণ-এর মূল উপজীব্য চাঁদ সদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান।

পদ্মপুরাণ এর কাহিনী বিশাল ও বিস্তৃত, তবে আমার সংক্ষিপ্ত আকারে লেখার প্রয়াস মাত্র। মনসা সর্প দেবী হওয়ার কারণে স্বর্গলোকে দেবীত্ব লাভে বাধা আসে। দেবাদিদেব মহাদেব শিব মনসাকে বলেছিলেন তুমি স্বর্গের দেবীত্ব স্বীকৃতি লাভ করতে হলে, তোমাকে মর্ত্যে শিবের উপাসক দ্বারা পূজিত হতে হবে। চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর ও তার ব্যবসায়ীক সতীর্থ সাহার কন্যা বেহুলা। চাঁদ সওদাগর ছিলেন হিন্দু দেবতা শিবের একনিষ্ঠ পূজারী। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের চম্পক নগরের একজন ধনী ও ক্ষমতাশালী বণিক। অপরদিকে শিবের কন্যা মনসা ছিলেন সর্পদেবী, কিন্তু তিনি কোথাও পূজিতা হতেন না। তখন মনসা চাঁদ সওদাগরকে অনুরোধ করেন মনসা পূজার আয়োজন করার জন্য, কিন্তু শিবের উপাসক চাঁদ সওদাগর শিব ব্যতীত কাউকে পূজা করবেন না সাফ জানিয়ে দেন। তখন ক্রোধোন্মত্ত মনসা তাঁকে শাপ দেন যে তাঁর প্রত্যেক পুত্রের জীবন তিনি বিনাশ করবেন। এরপরেও চাঁদ মনসার পূজা করতে অস্বীকার করলে, মনসা একে একে লখিন্দর ব্যতীত চাঁদ সওদাগরের সকল পুত্রই সর্পদংশনে প্রাণনাশ করেন। ভগ্নহৃদয় চাঁদ এতে বাণিজ্যে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও তিনি আবার বাণিজ্যে বের হন। সফল বাণিজ্যের পর তিনি যখন ধনসম্পদে চৌদ্দ ডিঙ্গা পূর্ণ করে গৃহে ফিরছিলেন তখন মনসা শুধুমাত্র চাঁদকে বাঁচিয়ে রেখে সব ডিঙ্গা ডুবিয়ে দিয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতে চাঁদ সওদাগর লখিন্দরের বিবাহের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে লৌহার বাসর ঘর নির্মাণ করেন বিশ্বকর্মা নামে একজন কারিগর। মনসা দেবীর চাপে তিনি লৌহপ্রাচীরে ছোট একটি ছিদ্র রেখে দেন। কিন্তু সকল সাবধানতা স্বত্ত্বেও মনসা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমর্থ হয়। তার পাঠানো একটি সাপ লখিন্দরকে হত্যা করে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে যারা সাপের দংশনে নিহত হতো তাঁদের সদকারে প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে তাদের মৃতদেহ কলার ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। তবে জনশ্রুতি ছিল যে ব্যক্তিটি হয়ত কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে ফিরে আসবে। বেহুলা সবার বাঁধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে। তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এই অবস্থায় মৃতদেহ পঁচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। ভেলায় ভাসতে ভাসতে মনসার সহচরী নেতার ঘাটে এসে ভিড়ল। বেহুলার প্রার্থনা শুনে নেতা তাঁকে মনসার কাছে নিয়ে গেলেন। তখন মনসা বললেন, তুমি লখিন্দরকে ফিরে পাবে, যদি তুমি তোমার শ্বশুড়কে আমার পূজারী করতে পারো। বেহুলা তাঁর শাশুড়িকে সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। বেহুলা তার শ্বাশুড়ির সহযোগীতায় চাঁদ সওদাগরকে মনসার উপাসনা করতে সম্মত হন। চাঁদের পক্ষে আর না বলা সম্ভব হয় না। কিন্তু মনসা তাঁকে যে কষ্ট দিয়েছিলেন, তা তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমা করতে পারেননি। তিনি বাম হাতে প্রতিমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মনসাকে পূজা করেন। মনসা তাতেই সন্তুষ্ট হন। তারপর মনসা অলৌকিক ক্ষমতাবলে লখিন্দর ক্ষয়ে যাওয়া মাংস ফিরে আসে এবং তাঁর চোখ মেলে তাকায়। এরপর লখিন্দর বেহুলার দিকে তাকিয়ে হাসে। ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে পৌছে দেন। চাঁদের ছয় পুত্রকেও মনসা জীবন দান করেন। চাঁদ সদাগরের ডুবে যাওয়া চৌদ্দ ডিঙ্গাও অক্ষত ভাবে ফিরিয়ে দেন। চাঁদ সদাগর ও তাঁর পরিবার সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে। এর পর মনসার পূজা বৃহত্তর জনসমাজে প্রচার লাভ করে। বিশেষ করে সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং সন্তান কামনায় মনসার পূজা করা হয়।

আবহমান কাল থেকে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে পুঁথি, পাঁচালি, মঙ্গল কাব্য, মনসা মঙ্গল পাঠ খুবই জনপ্রিয়। বিশেষজ্ঞদের মতে খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তন শুরু হয়। মধ্যযুগের কবি হরিদত্ত , বিজয়গুপ্ত, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস পিপলাই প্রমুখ রচিত বাংলা সাহিত্যের আলোচিত মনসামঙ্গল কাব্য। এই কাব্যে সেযুগের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি ফুটে উঠে। বিশেষ করে শ্রাবণ মাসে (পুরা মাসব্যাপী) মনসা পূজার আগে পুঁথি পাঠ সম্পন্ন করতে হয়।

বগুড়া শহরের অদূরে ও মহাস্থানগড়রের কাছাকাছি গোকুল মেধ নামে একটি জায়গায় স্থানীয়ভাবে বেহুলার বাসরঘর বা লখিন্দরের মেধ নামে এখনও সুপরিচিত। যুগ যুগ ধরে বেহুলা ও লখিন্দরের স্বামীভক্তি ও স্বামীর প্রতি প্রেম কাহিনীকে কেন্দ্র করে অনেক সিনেমা, নাটক ও সিরিয়ালও তৈরি হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এমন দুঃসাহসী অমর ভালোবাসার কাহিনী মানুষের মুখে মুখে এখনো জনপ্রিয়।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পদ্মপূরান,বেহুলা-লক্ষীন্দর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close