মতিউর রহমান মুন্না, এথেন্স (গ্রিস) থেকে

  ০২ নভেম্বর, ২০২২

গ্রিসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফোন হ্যাক করে চলছে প্রতারণা

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

গ্রিস প্রবাসী বাংলাদেশি ইয়াকুব আলীর ব্যবহৃত ইমো নাম্বার থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে দেশে থাকা তার স্ত্রীর ইমো নাম্বারে একটি বার্তা পাঠানো হয় আমি ঝামেলায় পড়ছি, আমাকে পুলিশে ধরছে, এখান থেকে ছাড়া পেতে বাংলার ৩০ হাজার টাকা লাগবে।

ইয়াকুব আলীর স্ত্রীর দিক থেকে কোনো জবাব না দেওয়ায় আরো একটি বার্তা পাঠানো হয় ‘কী হলো কিছু বলতেছ না কেন’, ‘আমার হাতে সময় খুব কম’, ‘টাকা পাঠাতে কতক্ষণ লাগবে, তাড়াতাড়ি জানাও আমারে’, ‘আমাকে খুব মারতেছে’, ‘বিকাশ পার্সোনাল নাম্বার ০১৮৯২৩৩১৮৮০’, ‘বাংলা ৩০ হাজার ৬০০ টাকা পাঠাও’, ‘টাকাটা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও এখন, না হলে পুলিশ এক বছরের জন্য জেল দেবে’।

এভাবেই একের পর এক আবেগঘন বার্তা পাঠানো হয় ইয়াকুব আলীর স্ত্রীর কাছে। মোবাইল ফোন কাছে না থাকায় তাৎক্ষণিক বার্তাগুলো দেখেননি স্ত্রী। জবাব না পেয়ে একপর্যায়ে ইয়াকুবের ইমো নাম্বার থেকেই কল দেওয়া হয় তার স্ত্রীকে। কল রিসিভ করার পর জনৈক এক ব্যক্তি বলেন, ‘আপনার স্বামীকে পুলিশে ধরেছে। তাকে ছাড়াতে চাইলে তাড়াতাড়ি ওই নাম্বারে ৩০ হাজার ৬০০ টাকা বিকাশে পাঠান, নয়তো এক বছরের জন্য জেলে দেবে।’ এ কথা বলে কল রেখে দেন ওই ব্যক্তি। এসব কথা শুনে এবং স্বামীর নাম্বার থেকে ইমোতে পাওয়া মেসেজ দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন গ্রিস প্রবাসী ইয়াকুবের স্ত্রী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গ্রিসে থাকা তাদের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তার স্বামী ইমো হ্যাকারের কবলে পড়েছেন। পরে তিনি হোয়াটসআপে কল দিয়ে নিশ্চিত হন, তার স্বামীকে পুলিশ ধরেনি, তিনি ভালো আছেন এবং তার ইমো হ্যাক হয়েছে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে গ্রিস প্রবাসী ইয়াকুব আলী প্রতারণার শিকার হওয়ার এমন কথা জানান।

কীভাবে হ্যাক হলো ইমো? এ প্রসঙ্গে প্রবাসী ইয়াকুব আলী বলেন, ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর গ্রিসের সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে ‘বিডি অ্যাম্বাসি’ লেখা একটি ইমো থেকে কল আসে ইমোতে। কল দিয়ে এক লোক বলেন, আপনার হাতের নাম্বার বন্ধ কেন? আপনাকে অনেকবার কল দিয়েও পাচ্ছি না। তখন আমি বলি, আমার সিম তো চালুই আছে, তখন অপরপ্রান্ত থেকে বলে তাহলে লাইনে থাকেন আমি কল দিয়ে দেখি, এ কথা বলে +১ ৩১৯-৫৮২-**** নম্বর থেকে কল দেওয়া হয় মোবাইল ফোনে। তখন আমাকে বলে এখন তো কল গেছে, আমি বললাম হ্যাঁ, এখন কল এসেছে। তখন সে বলে, আমার কোন নাম্বার থেকে কল গেছে, লাস্টে কত? তখন আমি সরল মনে শেষ চারটি সংখ্যা বলে দিই। এরপর ভালো থাকেন পরে কল দিচ্ছি, বলে রেখে দেয়।

ইয়াকুব জানান, এরপরই তিনি বুঝতে পারেন তিনি ইমো হ্যাকারের ফাঁদে পড়েছেন। তার ইমো থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুসহ বিভিন্ন মানুষের কাছে মেসেজ দিয়ে টাকা চাওয়া হয়। এমনকি তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে তার স্ত্রীর কাছে মেসেজ ও কল দেয় প্রতারক চক্রটি। একপর্যায়ে ভয়ে তিনি ইমো ডিলিট করে দেন। তার পরিচয়ে কারো কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছি কি না, তা এখনো জানতে পারেননি ইয়াকুব।

এভাবেই প্রবাসীদের ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। ইয়াকুবের স্ত্রীর মতো কেউ হয়তো ভাগ্য বা বুদ্ধির জোরে বেঁচে গেলেও অনেকে সরলতার কারণে ফাঁদে পা দিচ্ছেন। তেমন একজন গ্রিস প্রবাসী নজরুল ইসলাম। ইমো প্রতারণার ফাঁদে পড়ে প্রতারক চক্রকে টাকা দিয়েছেন তার বোন।

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইমো কলে দূতাবাস কর্মকর্তা পরিচয়ে একজন প্রবাসী কল্যাণ কার্ড বানানোর জন্য আমার নাম তালিকাভুক্তির কথা জানান। এজন্য মোবাইল নম্বর নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের জন্য একটি কোড পাঠিয়ে শেষের চার সংখ্যা জানতে চাইলে আমি বিশ্বাস করে দিয়ে দিই। এরপরই আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়।’

প্রতারকরা নজরুলের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ ৩০-৩৫ জনের কাছে টাকা ধার চেয়ে মেসেজ পাঠায়। তার মধ্যে একজন ছিলেন দেশে থাকা তার ছোট বোন। বিকাশ নম্বর দিয়ে পাঠানো মেসেজ লেখা ছিল, ‘আপা আমি খুব বিপদে আছি। আমার ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন, তাড়াতাড়ি দিলে খুব উপকার হবে।’ প্রবাসী ভাই বিপদে পড়েছে মনে করে বোন বিকাশে ২০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন।

৩-৪ বছর ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গ্রিসেও এমন ইমো প্রতারণার ঘটনার শিকার হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। চক্রের সদস্যরা ইমোর মাধ্যমে প্রবাসীদের নম্বর সংগ্রহ করে পরে একটি ওয়ানটাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) পাঠিয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে কৌশলে বিভিন্ন অজুহাতে ওটিপি নিয়ে সেই আইডি হ্যাক করে। প্রবাসীদের তারা বেশির ভাগ সময়ই দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয়ে কল দেয়। ইমো অ্যাকাউন্টটি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেই সাধারণত ওই অ্যাকাউন্টধারীর আত্মীয়স্বজনের কাছে কল করে বা মেসেজ পাঠিয়ে বিপদে থাকার কথা বলে টাকা ধার চায় প্রতারকরা।

এমনকি চক্রটির ফাঁদে পড়েছেন প্রবাসে থাকা অনেক নারী। অনেক নারী ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। ইমোর গোপন ছবি ও রেকর্ডকৃত কণ্ঠকে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ।

আবার অনেকেই প্রতারকদের কল পেলেই বুঝতে পারেন, তাই তাদের ফাঁদে আটকাতে পারে না। তাদেরই একজন গ্রিস প্রবাসী স্বপন তালুকদার। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন ইমো হ্যাকিং প্রতারণার ফাঁদ থেকে।

ইমো হ্যাক বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা প্রবাসীদের আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলছেন, মোবাইল ফোনে কোনো ওটিপি বা কোড পাঠালে তা কাউকে জানানো থেকে বিরত থাকুন। প্রতারকরা বিভিন্ন পরিচয়ে কল দিয়ে কোড জানতে চাইবে, তা দেবেন না। আত্মীয়স্বজন পরিচয়ে কেউ টাকা চাইলে বিকল্প নাম্বার বা অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করে কথা বলে আগে নিশ্চিত হবেন।

আপনার ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে কি না বা হ্যাক হলে হ্যাকারের তথ্য অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি অপশনে ঢুকে ম্যানেজ ডিভাইসে ক্লিক করলেই বুঝতে পারবেন।

দূতাবাসের নাম ব্যবহার করে প্রতারণার বিষয়টি এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের নজরেও এসেছে এবং এরই মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এ রকম কোনো ফোন করা হচ্ছে না। দূতাবাস থেকে ফোন করে কখনো কোনো কোড চাওয়া হয় না।’

মিনিস্টার ও দূতালয় প্রধান মোহাম্মদ খালেদ বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারণার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সচেতনতার বিকল্প নেই। আমরা সেদিকেই বেশি জোর দিচ্ছি। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও কমিউনিটির সমাবেশ-অনুষ্ঠানগুলোতে বিষয়টি তুলে ধরে প্রবাসীদের সচেতন করার চেষ্টা করা হয়।’

স্মার্টফোনের পাসওয়ার্ড বা কোড নম্বর কারো সঙ্গে শেয়ার না করা, নিশ্চিত না হয়ে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের সচেতন করার জন্য প্রবাসীদের প্রতি আমরা অনুরোধ করছি। আশা করছি নিজেদের স্বার্থেই তারা সতর্ক থাকবেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রবাসীদের ফোন হ্যাক,প্রতারণা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close