রাহাত হোসেন, হাবিপ্রবি প্রতিনিধি
সাক্ষাৎকার
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাংকিং বাড়াতে প্রয়োজন উন্নতমানের গবেষক পুল
দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) গবেষণা কার্যক্রম প্রতিনিয়ত বয়ে আনছে সুনাম। বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্মিলিত প্রয়াসে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা খাত।
কীটনাশকমুক্ত ধান উৎপাদনে এবং কোনো রকম বিষ ও হরমোন ব্যবহার ছাড়াই খুবই স্বল্প মাত্রায় ইউরিয়া (টিএসপি, পটাশ) ও ব্যাক্টেরিয়ার ব্যবহার করে টমেটো চাষে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আজিজুল হকের নেতৃত্বে থাকা তার গবেষক দল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার সামগ্রিক বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত হোসেন ।
প্রশ্ন : একজন গবেষকের মধ্যে কি কি দক্ষতা বা গুণ থাকা উচিৎ?
অধ্যাপক আজিজুল হক : আমি মনে করি, একজন গবেষকের অবশ্যই সুশৃঙ্খল ও দীর্ঘমেয়াদী নিজস্ব পরিকল্পনা থাকা দরকার। গবেষণার জন্য একটা নির্দিষ্ট বিষয় বেছে নিতে হবে। যার ফলে একটা জাতি বা সমাজ উপকৃত হবে । একজন গবেষককে অবশ্যই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। যার ফলে তিনি হবেন প্রশিক্ষিত এবং স্বাধীন গবেষক। তার মধ্যে থাকতে হবে অধ্যাবসায়, ধৈর্য্য ও ত্যাগের গুণাবলি। গবেষণার জন্য ত্যাগ করতে হবে সমাজ সংসারের অনেক কিছু। শুধু গবেষক হলেই হবে না, থাকতে হবে গবেষক তৈরির মানসিকতা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে গবেষণার ধারা অব্যাহত রাখতে হলে একজনে গবেষকের অধীনে থাকা শিক্ষার্থীদের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে তার অর্জিত জ্ঞান। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি গবেষণার সুফল পাওয়া সম্ভব।
প্রশ্ন : আমরা লক্ষ্য করছি, গবেষণার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে আপনি কি দেখছেন?
অধ্যাপক আজিজুল হক : ভার্সিটির প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনেই হয়তো এমন একটা সময় আসে যখন তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। আমিও এই সময় পার করে এসেছি। মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অনাগ্রহের একটা বড় কারণ বলে আমি মনে করি, আর্থিক সংকট। আমাদের ভার্সিটির কথাই যদি বলি, এখানে ল্যাবে গবেষণা করলে একজন শিক্ষার্থীকে আমরা তেমন কোনো আর্থিক অনুদান দিতে পারি না। এর পেছনে কারণটা হলো গবেষণার জন্য যে ফান্ড আমরা পাই তা খুবই কম। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা গবেষণার পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। সেখানে গবেষণায় নিযুক্ত শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বাজেট রাখা হয়। সঙ্গে স্কলারশিপ এর ব্যাবস্থা তো থাকেই। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, গবেষণার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে হবে। এর জন্য শিক্ষকদের ভূমিকাই মূখ্য হিসেবে আমি মনে করি। মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাত্রদের ও গবেষকদের জন্য গবেষণা ফান্ডিং এর ব্যাপারে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান তাদের লভ্যাংশের ১টি বড় শতাংশ গবেষণার জন্য সহজে অনুদান করে থাকেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এছাড়াও চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানগুলো তাই করে! এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ কতটুকু থাকে? আপনি কি মনে করেন গবেষণাখাতে বরাদ্দ বাজেট যথেষ্ট?
অধ্যাপক আজিজুল হক : গবেষণাখাতে সরকার বা ইউজিসি ক্রমানয়ে বাজেট বৃদ্ধি করেই চলেছে পরিচালকের চাহিদার প্রেক্ষিতে। সেই সঙ্গে শিক্ষক-গবেষকও বেড়ে গিয়েছে , দ্রবমূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে , রিয়াজেন্টর ভ্যাট ট্যাক্সও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকলেও অধিকতর ফলাফল পেতে আরো অনেকাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করার জন্য। পাবলিকেশন ইনসেন্টিভ বা গবেষণা প্রকাশ করার যে চার্জ সেটা যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহন করা হয় তাহলে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরো অনেক গবেষক তৈরি হবে ও নিয়মিত প্রকাশনা হবে । সেই সঙ্গে গবেষকদের বিভিন্ন রকম রিওয়ার্ড এর ব্যাবস্থা করা যেতে পারে । পুরষ্কার যে কাউকেই কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারে।
প্রশ্ন : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তো গবেষণার দিকে সবসময় নজর রাখতে হয়। গবেষণায় বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কি উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয় ?
অধ্যাপক আজিজুল হক : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় উন্নতি করতে হলে গবেষক পুল তৈরি করতে হবে এবং সেই গবেষক পুলের বিভিন্ন রকম গ্রেড থাকবে। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষকদের গবেষণার অর্জন, প্রকাশনা দেখে তাদের উন্নত মানের গবেষক পুল করতে হবে, যারা আগ্রহ ও ধৈর্যর মাধ্যমে আগামীতেও গবেষণার ফলাফল জাতির কাছে তুলে ধরতে পারবে। কোনো রকম পক্ষপাত ছাড়া টপ প্রোফাইলের গবেষক নির্ধারণ করার সাথে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট দিতে হবে। গবেষকের চাহিদার ভিত্তিতে অর্থ বন্টনের ন্যায্যতা থাকতে হবে। অভিজ্ঞ ও শীর্ষস্থানীয় গবেষক পুলের (প্রফেসরের) আন্ডারে নবীন শিক্ষক ও গবেষক শিক্ষার্থী থাকবে এবং যারা তার বিশেষ উচ্চ মানের প্রকল্প কাজ সম্পনের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হবেন। যদি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পুল গঠন করা হয় এবং পর্যাপ্ত বাজেট প্রদান করা হয় তাহলে গবেষণার মান বৃদ্ধি পাবে সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। গবেষণার টাকা রেশন নয় যে সবাইকে সমবণ্ঠন করতে হবে, প্রজেক্ট ও সক্ষমতা অনুযায়ী যার যত টুকু বাজেট দরকার তত টুকু দিতে হবে, সেই সঙ্গে সেই প্রকল্প পরিচালকের টিম থেকে অর্জিত ফলাফল উচ্চ মানসম্পূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্দালয়কে বুঝে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষকদের পর্যাপ্ত উৎসাহ, সমর্থন এবং সম্মান দিতে হবে।
প্রশ্ন : গবেষণার দিক দিয়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন অবস্থানে দেখতে চান ?
অধ্যাপক আজিজুল হক : অবশ্যই আমি এক নম্বরে দেখতে চাই। এক নম্বর দেখতে চাইলে তো হবে না সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সমন্বিত ভাবে কাজ করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সকল ধরনের সাবজেক্ট আছে কিন্তু সায়েন্স বা লাইফ সায়েন্সবিষয়ক সাবজেক্ট কম থাকায় গবেষণা করার সুযোগও কম আছে। গবেষণাখাতে রাংকিংয়ে উন্নতির জন্য সায়েন্সবিষয়ক ডিপার্টমেন্ট যেমন প্রাণরসায়ণ ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসি, মাইক্রোবায়োলজি, জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট গুলোর পূর্ণাঙ্গ বিভাগ খুলে অনার্স ও মাস্টার্স চালুকরণ প্রয়োজন। এইসব বিভাগে সঠিক সংখক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগদানের সঙ্গে পাঠদান ও গবেষণা চর্চা বাড়ালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় রাংকিংয়ের সর্বোচ্চ স্থান অর্জন করতে পারবে। জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্ৰার অর্জন লক্ষে গবেষণার ডিরেক্শন করতে পারলে ও অবদান রাখতে পারলে দেশের উন্নয়নের জন্য আরো ভালো হবে।
পিডিএস/এএমকে