হুসাইন মাহমুদ, চবি
ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীন চবি’র শিক্ষার্থীরা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বিশাল আয়তনের। জমির পরিমাণ ২৩০০ একর। সবুজ এই ক্যাম্পাসে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। কিন্তু সব স্থান ঘুরে দেখার সুযোগ পান না শিক্ষার্থীরা। সমস্যা নিরাপত্তাহীনতা। রয়েছে ছিনতাইকারী ও বখাটেদের খপ্পরে পড়ার ঝুঁকি। শ্লীলতাহানি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা এই উচ্চ বিদ্যাপীঠে ঘটেছে কয়েকবার। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পসের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে না যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের নিষেধ করেছে। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, নিরাপত্তা জোরদার করা হোক। তারা যেন প্রকৃতি থেকে জ্ঞান ও সৌন্দর্য আহরণের আবাধ সুযোগ পান তাদের প্রিয় এই ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয় হবে শহর থেকে দূরে, নির্জন, কোলাহলমুক্ত, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে, যেখানে প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে, প্রকৃতিই হবে তাদের শিক্ষক- জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক রুশোর এই অভিব্যক্তির অপূর্ব নিদর্শন নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমিখ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ ক্যাম্পাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করে। বোটানিক্যাল গার্ডেন, ঝুলন্ত ব্রিজ, টেলিটক পাহাড়, ফরেস্ট্রি, চালন্দা গিরিপথ, স্লুইসগেট, ঝরনাসহ পুরো ক্যাম্পাস শিক্ষা কেন্দ্রের পাশাপাশি একটি নির্মল বিনোদন কেন্দ্র। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব দর্শনীয় স্থানের অধিকাংশ জায়গায় প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখা আমাদের অধিকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচিত এই জায়গাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া।
সরেজমিনে দেখা যায়, চবি প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে, টেলিটক পাহাড়, ঝরনা, স্লুইস গেট, বোটানিক্যাল গার্ডেন, পাম বাগান। এই দর্শনীয় স্থানগুলোর আড়ালে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসীদের আখড়া। তারুণ্যের উদ্দীপনায় অনেক শিক্ষার্থী এই স্থানগুলোতে প্রবেশ করে সন্ত্রাসীদের পাতা ফাঁদে শিকার হয়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নবীনদের সংখ্যা সব থেকে থেকে বেশি। এই স্থানগুলোতে অনেক সময় নারী শিক্ষার্থীরাও যৌন হয়রানির শিকার হন। এই স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পরে প্রশাসনকে আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
গত বছর ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধিত স্থান বোটানিক্যাল গার্ডেনে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করে ভিডিও ধারণ করে ছাত্রলীগের পাঁচ কর্মী। অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তাদের প্রবেশ করতে না দেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন বোটানিক্যাল গার্ডেনে করে থাকেন।
সম্প্রতি ১৮ ফেব্রুয়ারি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পেছনে অবস্থিত টেলিটক পাহাড়ে একটি ছিনতায়ের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী এই দুজন ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এদের একজন মুরসালিন বলেন, ‘এদিন আমি ও আমার বন্ধু টেলিটক পাহাড়ে ঘুরতে যাই। হঠাৎ করে তিন-চারজন ব্যক্তি দেশীয় অস্ত্র সহকারে এসে আমাদের ওপর হামলা করে এবং আমাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনসেট ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। হামলার সময় তারা রামদা দিয়ে আমাকে আঘাত করে পালিয়ে যায়’। এই ঘটনা ঘটার পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন টেলিটক পাহাড়ে গার্ড নিয়োগ দেওয়ার কথা বললেও তা কথার মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এর আগে ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ১৬ জন নবীন শিক্ষার্থী এক সঙ্গে ছিনতাইয়ের শিকার হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং কলা ভবনের শেষ প্রান্তে সরু রাস্তা দিয়ে গেলে চোখে পড়ে নয়নাভিরাম পাহাড়ি ঝরনা। যা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আবেগের জায়গা। গত বছর ১৬ অক্টোবর ঝরনা দেখতে গিয়ে প্রাণ হারায় জিসান নামের এক স্কুলছাত্র। ২০১৫ সালে দুই শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর ঝুঁকিপূর্ণ লেখা সাইনবোর্ড সাঁটিয়েই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। নেয়নি কার্যকর পদক্ষেপ।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় ফরেস্ট্রি, পামবাগান ও সেন্ট্রাল ফিল্ডে মাঝে মধ্যেই ছিনতায়ের ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের দাবি প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রোমানা বলেন, ‘চবি ক্যাম্পাসের দর্শনীয় স্থানগুলোর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মত পদক্ষেপকে আমি অত্যন্ত নিম্নমানের একটি সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। বরং প্রশাসনের উচিত নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। যাতে শিক্ষার্থীরা ভ্রমণে গিয়ে কোনো ধরনের নিরাপত্তাজনিত সমস্যার মুখোমুখি না হন। প্রশাসনের এই যে নিষেধাজ্ঞা, তা প্রশাসনের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে।’
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সম্পা আক্তার বলেন, ‘চবির দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমাদের মতো নবীন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের সব জায়গা এখনো ভালোভাবে দেখতে পারেনি।’
ক্যাম্পাসের প্রতিটি জায়গা ঘুরে দেখা আমাদের অধিকার। আমি চাই, প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে এই দর্শনীয় স্থানগুলো উন্মুক্ত করে দেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রবিউল হাসান ভুঁইয়া প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩০০ একরের প্রতিটি জায়গায় যাওয়ার অধিকার শিক্ষার্থীদের রয়েছে। কিন্তু লোকবল কম থাকার কারণে আমরা সব জায়গায় নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করতে পারছি না। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে নির্দেশিকা সংবলিত সাইনবোর্ড দিয়ে রেখেছি। চবির দর্শনীয় স্থানগুলোতে এরই মধ্যে আমরা গার্ড নিয়োগ করেছি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য চেষ্টায় আছি। শিক্ষার্থীদের উচিত আমাদের ওপর বিশ্বাস রেখে ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় না যাওয়া’।
নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান শেখ মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের গার্ড আছে ৩০০ জন। তবে বেশিরভাগ সময় ২৫ থেকে ৩০ জন গার্ড ছুটিতে থাকে। এজন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি জায়গায় নিরাপত্তা দিতে পারছি না। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি, যাতে আরো ১০০ জন গার্ড নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি জায়গায় নিরাপত্তা দিতে পারব’।
পিডিএসও/এমএ