হুসাইন মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চবির আবাসিক হলের ডাইনিংয়ে জোটে নিম্নমানের খাবার

ছোট একট টুকরো মাছ কিংবা মাংস, হলুদের গুঁড়া মিশানো বিস্বাদ ডাল আর কিছু সবজি এই খেয়েই দিন পার করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী।
মাংসের একটি টুকরো ২৩ গ্রাম, মাছের একটি টুকরো ২৬ গ্রাম। আলু ও পেঁপে দিয়ে স্বাদ গন্ধহীন সবজি। প্রতিটি হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনে প্রায় একই দৃশ্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে খাবারের সংকট আরো প্রকট হয়েছে। এতে মাঝে মাঝেই শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। খাবার সংকটে সব থেকে বেশি ভোগান্তির শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীরা।
খাদ্যের মান সম্পর্কে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ প্রবল কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ৬০-৮০ কেজি ওজনের একজন মানুষকে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম আমিষ, ৪০০ গ্রাম সবজি ও সঙ্গে কিছু ফলমূল খেতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের খাবার সম্পর্কে তাকে জানালে তিনি বলেন, এই পরিমাণ খাবার একটানা ১৫ দিন খেলে একজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। যদিও তরুণ বয়সের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর ওপর এখন এই খাদ্যের কুপ্রভাব নাও পড়তে পারে, তবে ভবিষ্যতে এর প্রভাবে অনেকেই জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৮ হাজার ৫৫২ জন। আবাসিক হল রয়েছে ১১টি। এর মধ্যে ছেলেদের ৭টি ও মেয়েদের ৪টি। ছেলে ও মেয়েদের হলের আসন সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। হলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এই ডাইনিংয়ের খাবারের ওপর নির্ভর করেন। তবে কিছু শিক্ষার্থী হলের খাবার খেতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া কিংবা হোটেলের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন। এতে তাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। কিন্তু সেখানেও তারা পাচ্ছেন না মানসম্মত খাবার।
সরেজমিনে দেখা যায়, আবাসিক হলের ডাইনিং, ক্যান্টিন, খোলা দোকান সবখানে খাবার রান্না ও পরিবেশন হয় চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। হলগুলোর রান্নাঘর যেন ময়লার ভাগাড়। সেখানে কর্দমাক্ত অবস্থায় পচা আলু, ধুলাবালির মধ্যে পাথরে ভরা চাল স্তূপ করে রাখতে দেখা যায়। সোহরাওয়ার্দী, আমানত, শাহজালাল আবদুর রব, শেখ হাসিনা, শামসুন নাহার হল ও অন্যান্য হলে প্রতিদিন দুপুর ও রাতে কম দামি পাঙ্গাশ মাছ, কই মাছ, তেলাপিয়া ও মাগুর মাছ রান্না হয়। সঙ্গে নিম্নমানের আলু, পেঁপে, কুমড়া, লাউ দিয়ে তৈরি হয় সবজি। মাসের পর মাস একই তালিকায় খাবার দেওয়া হচ্ছে। নেই পুষ্টিমানের কোনো চিন্তা। বরং কীভাবে আরো কম দামি খাবার দেওয়া যায় সেটাই চিন্তা করছেন হল ম্যানেজাররা। তাদের কথা খাইলে খান না খাইলে যান।
এ এফ রহমান হলের ডাইনিং ম্যানেজার মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, হল কর্তৃপক্ষ খাবারের জন্য আমাদের কোনো বরাদ্দ দেয় না, আবার অনেক ছাত্র হল থেকে ফাউ খেয়ে যায়, তাদের আমরা কিছু বলতেও পারি না। মাস শেষে হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিনিয়তই আমাদের কিছু না কিছু লোকসান হয়ে যাচ্ছে। হল কর্তৃপক্ষ যদি বরাদ্দ দেয় তাহলে আমরা এর থেকে ভালো খাবার দিতে পারব।
গত ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশন ও খাবারে তেলাপোকা পাওয়ার অভিযোগে আলাওল ও এ এফ রহমান হলের সম্মিলিত ক্যান্টিনে তালা দিয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একাংশ। এদিকে আবার সোহরাওয়ার্দী হল ক্যান্টিনে অভিযোগের শেষ নেই, একাধিকবার ক্যান্টিনে তালা মারার পরও কোনো সুরাহা মিলেনি।
এই ধরনের খাবার খেয়ে প্রায়ই অসুস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই বিষয়ে চবি মেডিকেলের চিফ মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, আমাদের মেডিকেলে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা পেটব্যথা, ডায়রিয়া, গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যা নিয়ে আসেন। হল ও আশপাশের হোটেলগুলোতে খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হচ্ছে। অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার খেয়েও অনেকে অসুস্থ হচ্ছে। প্রতি বছর গড়ে ২০ শতাংশ রোগী এই খাবার সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে আমাদের এখানে আসে। তবে শীতের সময় রোগীর সংখ্যা কিছুটা কম থাকে কারণ এ সময়গুলোতে সবজি পরিমাণে কিছু বেশি পাওয়া যায়।
শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. রকিবা নবী বলেন, সরকারি ভর্তুকিসহ ২৫ টাকার মধ্যে আমরা যে খাবার দিচ্ছি তা যথেষ্ট। যদিও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাবারের পুষ্টিমান কম হচ্ছে তবে আমরা চেষ্টা করছি এর মধ্যে ভালো খাবার দিতে। আমি প্রতি মাসে অন্তত একবার করে হলেও ছাত্রীদের সঙ্গে খাবার খেয়ে খাবারের মান যাচাই করি।
তিনি আরো বলেন, ছাত্রীরা আমার কাছে কিছু টাকা বাড়িয়ে খাবারকে আরো মানসম্মত করতে বলছে। এ বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি দ্রুত তারা পদক্ষেপ নেবেন।
সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট ড. শিপক চন্দ্র দেব নাথ বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে আমরা খাবারের পুষ্টিমান বজায় রাখতে পারছি না। তবে আমরা এই ২৫ টাকার মধ্যে যথেষ্ট ভালো খাবার দিচ্ছি। আমি আমার হলে কিছু সোর্স রেখেছি যারা আমাকে খাবার সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তথ্য দিয়ে থাকে। আমার হলে পচা-বাসি খাবার খাওয়ানো হয় না, প্রতিনিয়তই টাটকা খাবার খাওয়াই আমরা।
সহকারী প্রক্টর ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, খাবারের মান সম্পর্কে আমরা প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছি। আমরা শিগগিরই প্রভোস্টদের সঙ্গে বসব এবং কীভাবে খাবারের মান বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করব।
ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মতিউর রহমান বলেন, হলের ডাইনিংয়ে যে খাবার আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা মেটাবে, সেটা খেয়ে বরং আমরা মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমার মনে হয় এর জন্য তরকারির ঝোলে ভেসে থাকা পোড়া তেল অনেকটাই দায়ী। বাইরের হোটেলগুলোতে খেতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয় বিধায় বাধ্য হয়ে আমাদের এগুলোই খেতে হচ্ছে।
বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাবাইয়া তাবাচ্ছুম যৌথ বলেন, আমি প্রীতিলতা হলে থাকি, আমাদের হলের খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। ডাইনিংয়ে কম দামে খাবার পাওয়া যায় বলে প্রথমে দিকে আমি ডাইনিংয়ে খাওয়া শুরু করলাম কিন্তু কিছুদিন পরেই আমি অসুস্থতা বোধ করি। তাই একটু ভালো খাবারের আশায় আমি এখন ক্যান্টিনে খাই কিন্তু সেখানেও খাবারের মানের খুব বেশি পার্থক্য নেই। তাই বাধ্য হয়ে রান্না করতে হয় এতে আমার প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে এবং বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। আমাদের চাওয়া, যাতে হলের খাবারের মান আর একটু ভালো করা হয়।
পিডিএসও/এমএ