আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

জ্বালানি সংকট সমাধানে সাইকেল

ছবি : সংগৃহীত

আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য বটে। অনেকগুলো বৈশ্বিক সূচকেই সেটি প্রতীয়মান। কিন্তু সেসব অর্জন কতটা টেকসই হয়েছে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেছে। কারণ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের জীবনের ওপর যান্ত্রিকতাবাদ চেপে বসেছে, বিশেষ করে শহর জীবনে। বাংলাদেশের শহুরে জনসংখ্যার ৩২ শতাংশের বসবাস রাজধানী ঢাকায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সিংহভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে রাজধানীর জনসংখ্যা সীমা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সত্তরের দশকের মতো বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জলবায়ু বিপর্যয়, জ্বালানি সংকট ও শহরের তীব্র যানজটের জন্য প্রধানত দায়ী ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি। যার ফলে নগরবাসীরা তীব্র যানজট, বায়ু ও শব্দদূষণের ভোগান্তিতে পড়ছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়িকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গণপরিবহন ব্যবস্থা অনুন্নত থেকে গেছে। যার কারণে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে গেছে, ফলে ঢাকার যানজট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং বায়ুদূষণেও শীর্ষে অবস্থান করছে। এ সংকট ও উদ্বেগ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হতে পারে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো।

বায়ুদূষণের পর এবার শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে রাজধানী ঢাকা। সম্প্রতি জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে তা শুধু রাজধানী ঢাকাতে নয়; সারা দেশেই শব্দদূষণ বাড়ছে। যানজট বাধলেই সব ধরনের যানবাহনে চারপাশ থেকে হর্ন বাজানো শুরু হয়। তখন জটের মাঝে আটকে থাকা মানুষের কান ঝালাপালা হওয়ার দশা। কারণ কিছু লোক মনে করে, শুধু হর্ন বাজালেই যানজট কেটে যাবে। ঢাকা শহরের মোট সড়কের প্রায় ৫০ শতাংশ জুড়েই চলাচল করে ব্যক্তিগত গাড়ি, অথচ এগুলো বহন করে মাত্র ১২ শতাংশ যাত্রী। যানজট, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও রাষ্ট্রের অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হচ্ছে, তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে। ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভরতা বৃদ্ধি অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে উঠছে অতিমাত্রায় যানজট। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোয় যে পরিমাণ গাড়ি চলাচলের ক্ষমতা, বাস্তবে গাড়ি চলাচল করে তার ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এবং যাতায়াত ও পরিবহন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ার বিষয়টি দিনে দিনে আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে, যা বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে রাজধানীকে নামিয়ে আনছে নিচের সারিতে। প্রতিটি আধুনিক ও উন্নত শহরে যাতায়াতের অন্যতম প্রধান বাহন গণপরিবহন। অথচ ঢাকা শহরে তার উল্টো চিত্র।

রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক ট্রাই-সাইকেল (পরিবেশবান্ধব বাহন রিকশা) চলাচল বন্ধ করার অপচেষ্টা চলছে, যা অনেকটা আত্মঘাতী ও হটকারী সিদ্ধান্ত বলা যায়। ঢাকা শহরের বিশালসংখ্যক মানুষ যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে রিকশা ব্যবহার করে থাকেন। অন্যান্য শহরেও যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে বাহন হিসেবে গ্রহণযোগ্য স্বীকৃতি লাভ করেছে রিকশা। তার পরও ১৯৮৭ সালের পর ঢাকা শহরের রিকশা চলাচলের জন্য আর লাইসেন্স বা অনুমতি প্রদান করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে খুঁড়া যুক্তি ও অজুহাত দেওয়া হয়ে থাকে, রিকশার কারণে ঢাকা শহরের যানজট হচ্ছে। তর্কের খাতিরে তা মেনে নিলেও উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মিরপুর রোড়ে ও ভিআইপি রোড়ে ২০০৪ সাল থেকে রিকশা চলাচলের অনুমতি নেই। ওই সড়কগুলোতে তাহলে প্রতিনিয়ত মানুষকে যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে কেন! এর কোনো সঠিক জবাব নেই।

একসময় বলা হতো শহরের কয়েকটি স্থানে উড়ালসড়ক নির্মাণ করলেই যানজট কমবে। কিন্তু উড়ালসড়ক নির্মাণ করার পরও সমস্যা কমেনি, বরং উড়ালসড়কের কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে বলা যায়। করোনা মহামারির সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায়, অনেক মানুষ ঘর থেকে বের হননি, কিছু অফিস চালু থাকলেও সবাই পালাক্রম করে অফিস করেছেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলে দেওয়ায় যানজট পুরোনো চেহারায় ফিরে এসেছে। বিশেষ করে এই মার্চ মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর যানজট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যাকে শহরের জন্য ক্যানসার বলা যায়। করোনার আগে সকাল ও বিকেলে অফিস খোলা ও বন্ধের সময় বেশি যানজট ছিল। এখন সব দিন ও সব সময় নগরবাসীকে যানজট ও শব্দদূষণের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। এর মধ্যে গত ১০ বছরে নিবন্ধন হয়েছে ১১ লাখ। কিন্তু সে তুলনায় সড়ক বাড়েনি; বাড়ানো সম্ভবও নয়। ঢাকা শহরের যানজট ও দূষণ নিয়ে নানা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কথা শোনা যায়। যানজট ও বায়ুদূষণ এবং শব্দদূষণ নিরসনে যে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু এই ভয়াবহ সমস্যা নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো কেন অদৃশ্যমান! এটি একটি প্রশ্ন। কিছু মানুষ এর পরও বলছে মেট্রোরেল চালু হলেই ঢাকায় যানজট থাকবে না। উত্তরটা ভবিষ্যৎই দেবে। এদিকে সত্তরের দশক থেকে জ্বালানি সংকট সমাধান, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে এবং বায়ুদূষণ কমাতে গাড়িমুক্ত শহর আন্দোলন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের এখন প্রায় ৪ হাজার শহরে প্রতি বছর ২২ সেপ্টেম্বরে এই ‘গাড়িমুক্ত দিবসটি’ পালিত হয়ে থাকে। বিশ্বগাড়িমুক্ত দিবস ২০২২-এর প্রতিপাদ্য ‘জ্বালানি ব্যবহার ও যানজট নিয়ন্ত্রণ করি, ব্যক্তিগত গাড়ি সীমিত রাখি’। যানজট নিরসন, জ্বালানি সংকট সমাধান, জলবায়ু বিপর্যয় রোধ ও যাতায়াত ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে সাইকেল। সাইকেল আধুনিক সভ্যতার আশীর্বাদ। অতীতকালেও যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে বাহন হিসেবে সাইকেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেটা বাইসাইকেল বা ট্রাইসাইকেলই হোক, দুটিই পরিবেশবান্ধব বাহন। এই দুটি বাহন ব্যবহার করতে জীবাশ্ম জালানি পোড়ানো লাগেনা। জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষ যখন শহর ও নগরমুখী হয়েছিল, তখন থেকে সাইকেলের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। যে দূরত্বে হেঁটে যাতায়াত করা অনেক সময়সাপেক্ষ, সেই ক্ষেত্রে যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সাইকেল।

সাইকেল যে শুধু যাতায়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তাই নয়, পণ্য পরিবহনেও এই বাহনের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটা পথে ৫-১০ ঘণ্টার পথ, অনেক কম সময়ে কোনো ক্লান্তি ছাড়াই এ রকম বাহন ব্যবহার করে যাতায়াত করা অনেক সহজ। পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির কোনো ধরনের ক্ষতি না করে এই বাহন ব্যবহার সম্ভব। কোনো ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা লাগে না সাইকেল ব্যবহার করতে। ফলে শহরের বায়ুদূষণ কমে আসবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ইতিবাচক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সাইকেল ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। যারা শরীরচর্চা ও ব্যায়াম করার জন্য আলাদা সময় পান না এবং যারা ব্যায়ামের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেন, তাদের জন্য শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের আলাদা সময়ের দরকার হবে না, যা স্বাস্থ্য উন্নয়নে ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

সাইকেল অনেক আগের আবিষ্কার হলেও এটি আধুনিক। ৭০-এর দশকে সারা পৃথিবীতে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিলে, বিশেষ করে ইউরোপে তখন মানুষ সাইকেল ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে থাকে। কারণ সাইকেল ব্যবহারে কোনো ধরনের জীবাশ্ম জালানি ব্যবহার করা লাগে না। করোনা মহামারি পরিস্থিতিতেও নিরাপদে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে বাহন হিসেবে সাইকেল স্বীকৃতি লাভ করেছে। যেহেতু সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জীবন ও জীবিকার জন্য যাতায়াত করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে বাইসাইকেল রপ্তানিতে পৃথিবীতে ৩য় অবস্থানে রয়েছে। রপ্তানিতে পৃথিবীতে প্রথম সারির দেশ হলেও রাষ্ট্র্রের পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়টি তেমন দৃষ্টি নেই। নিরাপদ যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে বাহন হিসেবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও মিলছে না। যারা সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করেন তাদের জন্য নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা। বাইসাইকেলের জন্য শহর ও নগরের আলাদা আলাদা লেন নেই। যদিও ঢাকা শহরের (মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আগারগাঁওয়ে) দুটি বিক্ষিপ্ত বাইসাইকেল ইেন করা হয়েছে, এই সাইকেল লেনগুলোর সঙ্গে অন্য সড়কের কোনো সংযোগ নেই। আবার সাইকেল লেনগুলোতে গাড়ি পার্কিং করে রাখার দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়।

ব্যক্তিগত যান্ত্রিক যানবাহনের যাতায়াতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যতটা পৃষ্ঠপোষকতা করছে, অযান্ত্রিক বাহনে অর্থাৎ সাইকেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তা করছে না। সেটা হোক বাইসাইকেল বা ট্রাইসাইকেল। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে আমরাই যেহেতু ভুক্তভোগী, তাই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে অযান্ত্রিক বাহননির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে, তা রাষ্ট্রের জন্য পৃথিবীব্যাপী অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে অযান্ত্রিক যানবাহন (যেমন : রিকশা ও সাইকেল)। এসব অযান্ত্রিক যানবাহন জলবায়ু বিপর্যয় রোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। উন্নত হাঁটাপথ ও ফুটপাতের মাধ্যমে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যাতায়াত নিশ্চিত করা গেলে শরীরচর্চার পাশাপাশি অর্থ সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি জ্বালানি নির্ভরতা কমে আসবে। তাই ভয়াবহ যানজট, শব্দ ও বায়ুদূষণ এবং জ্বালানি সংকট থেকে ঢাকা শহরবাসীকে মুক্তি দিতে নীতিনির্ধারকদের সাইকেলবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জ্বালানি সংকট,জ্বালানি সংকট সমাধানে সাইকেল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close