অনিরুদ্ধ বিশ্বাস, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

  ১০ জানুয়ারি, ২০২২

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃদেশীয় গবেষণা

অপরিকল্পিত নগরায়নে সামাজিক ও ধর্মীয় বিভাজনের অশনিসংকেত

গত দশ বছরে বাংলাদেশের শহরগুলোতে ধর্ম, উপার্জন সক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধাসহ নানা ধরনের বিষয়কে ঘিরে আশঙ্কাজনক বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। একই সাথে শহরের প্রান্তে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত বসতি স্থাপনের ফলে শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে। অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বসবাসের অযোগ্য শহর তৈরি হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা (ইউআরপি) ডিসিপ্লিনের ব্যতিক্রমী গবেষণায় বাংলাদেশ অংশে এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্বদানকারী ও খুবির ইউআরপি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. শিল্পি রায় আশঙ্কা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের শহরগুলোর সামাজিক বিভাজন ও শহরতলির পরিবর্তন উদ্বেগজক। এ উদ্বেগ বার্তায় নীতি-নির্ধারকরা সাড়া দিলে আমাদের গবেষণা সার্থক হবে।

সেন্টার ফর সাসটেইনেবল, হেলদি অ্যান্ড লার্নিং সিটিজ অ্যান্ড নেইবারহুডসের (এসএইচএলসি) আন্তঃদেশীয় গবেষণা প্রকল্পটি বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের সাতটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নগরায়নের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর টেকসই সমাধান নিয়ে গত চার বছর ধরে কাজ করছে। বাংলাদেশে নগর পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটি সবচেয় বড় আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্প।

ঝুঁকিপূর্ণ নগরায়ন গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে আশঙ্কাজনক হারে নগরায়ন হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরের আয়তন ৩০৭ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু গত ৩০ বছরে ঢাকার আশপাশে ২৫৪ বর্গ কিমি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে উঠেছে। অপরদিকে একই সময়ে খুলনায় (আয়তন ৪৬ বর্গ কিমি) বেড়েছে প্রায় ১৮ বর্গ কিমি এলাকা। ঢাকায় গড়ে প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে নগরায়ন হচ্ছে, যে হার খুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ।

নতুন গড়ে ওঠা এসব বসতি কেড়ে নিয়েছে কৃষি জমি ও জলাভূমি। নগরায়নের এই প্রক্রিয়ায় ঢাকার পাশের অঞ্চল হারিয়েছে ২৩৪ বর্গ কিমি কৃষি জমি ও ৩২ বর্গ কিমি গাছপালা ও জলাভূমি। অপরদিকে খুলনায় হারিয়েছে প্রায় ৪২ বর্গ কিমি কৃষি জমি ও প্রায় ৫ বর্গ কিমি জলাশয়।

শহরের বাইরে অপরিকল্পিভাবে দ্রুতগতিতে নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এখানে সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সড়ক যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সেবার অপ্রতুলতা রয়েছে। শহরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি। এর ফলে শহরের ভেতরের ইতোমধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ প্রায় ৭০ শতাংশ মহল্লা আরও ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে।

সামাজিক বিভাজন যদিও ঢাকা এবং খুলনা উভয় শহরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা শহরজুড়ে বসবাস করছেন। অথচ সনাতন ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতেই বসবাস করেন। উদাহরণস্বরূপ রাজধানীর পুরান ঢাকা ও খুলনার বড়বাজার এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাসের হার মূল শহরের তুলনায় যথাক্রমে দশগুণ ও দ্বিগুণ বেশি। ধর্মের এই প্রান্তিকতা বাড়তে থাকলে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময় ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

আবার এদিকে ধর্ম ছাড়াও ঢাকা শহর সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিভাজিত। নগরীর কিছু জায়গা যেখানে অভিজাত মানুষদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিতি, সেখানে অপর একটি অংশ নিম্ন আয়ের মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়ের ভিত্তিতে ঢাকা শহর ৮ ও খুলনা শহর ৫ শ্রেণিতে বিভাজিত হয়ে পড়ছে।

উভয় শহরেই নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্থানিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। ঢাকার ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ বাড়িতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। খুলনাতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। ঢাকা শহরে গত ২০ বছরে সরকারি উদ্যোগে কোনো বিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ মধ্য ও নিম্ন আয়ের এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় মানসম্মত স্কুল অপ্রতুল। কিন্তু অভিজাত আবাসিক এলাকায় ব্যয়বহুল ও মানসম্মত স্কুল আছে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উভই শহরে নাজুক। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ক্লিনিক, ফার্মেসি ইত্যাদি গড়ে ওঠায় যানজট সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার প্রান্তিক এলাকার মানুষকে এই সুবিধা নিতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।

সুপারিশ ও সমাধান বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া নানা পরিকল্পনার অধীনে ঢাকায় কিছু উন্নয়নকাজ হলেও খুলনার ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই কম। এ সকল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গবেষকরা নীতি-নির্ধারকদের উদ্দেশ্যে ৪টি প্রধান সুপারিশ করেছেন। প্রথমত, ঢাকা এবং খুলনা উভয়ের জন্য শহরতলীর পরিকল্পনাটাই আগামীর মূল চ্যালেঞ্জ। তবে এই পরিকল্পনা শহরের ভেতর থেকে শহরের বাইরের এলাকার জন্য বেশি প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, শহরে মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে বিভাজনটা কমানো প্রয়োজন। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা খুবই জরুরি। তৃতীয়ত, পরিকল্পনা বাস্তবতার আলোকে ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে তৈরি করতে হবে। এখানে পশ্চিমা ধারনার প্রভাব কমিয়ে আনতে হবে। একই সাথে পরিকল্পনাগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে তাতে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। চতুর্থত, ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মানুষের মাঝে রাজধানীমুখী হবার প্রভাব না কমাতে পারলে শুধু ঢাকা নয় খুলনাসহ অন্যান্য শহরগুলোর সমস্যা দূর হবে না। তবে এ বিষয়ে শুধু ঢাকা বা খুলনাকে নিয়ে ভাবলে হবে না। জাতীয় পর্যায়ে মানুষের জীবন ব্যবস্থার একটা চিত্র দাঁড় করাতে হবে। পাঁচ বছরব্যাপী জাতীয় পরিকল্পনার সাথে নগরায়ন পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটাতে হবে। আবার মহল্লা পর্যায়ে গবেষণা ও পরিকল্পনা বৃদ্ধি করতে হবে।

ইন-কান্ট্রি কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবে একই ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক তানজিল সওগাত বলেন, ভবিষ্যতে ঢাকা ও খুলনায় নগরায়নের রুপরেখার জন্য নগরায়নের যে গতিপ্রকৃতি আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, তা নীতি-নির্ধারকদের বিবেচনায় না আনলে আমরা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ব্যর্থ হবো।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা,খুলনা,নগরায়ন,গবেষণা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close