নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৮ জুন, ২০২১

রাজনীতিমুক্ত হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা!

উগ্রপন্থি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রদের নতুন করে ভর্তির ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ মাদ্রাসাগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক এমনকি কোনো সংগঠনে সক্রিয় থাকলেও ভর্তি না নেয়ার কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কওমি মাদ্রাসায় সাধারণ ক্লাসগুলোতে ভর্তির মতো বিশেষ কোর্সগুলোতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ইফতা (উচ্চতর ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগ), তাফসির (উচ্চতর কোরআন গবেষণা) ও আরবি সাহিত্য বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির ফল করা ছাত্রদের বাইরে অন্যদের ভর্তির বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো।

২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বর ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতায় করে ব্যাপক সহিংসতা চালানো হয়। এর পেছনে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় শতাধিক নেতা গ্রেপ্তার হন। এরপর বিভিন্ন মহলে দাবি উঠে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করার।

গত এপ্রিলে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রচলিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় মাদ্রাসাগুলোর নীতি-নির্ধারণী বোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করেছে কওমি বোর্ড। গত বুধবার বোর্ডের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আগের সিদ্ধান্ত (রাজনীতি মুক্তকরণ) বহাল রেখে তা বাস্তবায়নের জন্য দেশের সব কওমি মাদ্রাসাকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান সভায় সভাপতিত্ব করেন।

বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন থেকে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা যেন রাজনীতিতে যুক্ত হতে না পারেন সেজন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সব মাদ্রাসার প্রধানদের আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হচ্ছে। এরপরও যদি কোনো ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিতে যুক্ত হন, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কওমি শিক্ষাবোর্ডের অফিস সম্পাদক মু. অছিউর রহমান বলেন, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের প্রচলিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে গত এপ্রিলে বোর্ডের নেয়া সিদ্ধান্ত গত বুধবারের সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দেশের সব মাদ্রাসার প্রধানদের আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হবে। খুব শিগগিরই এ চিঠি পাঠানো হবে।

জানা গেছে, এপ্রিল মাসে নেয়া এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধানের জন্য আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়ার পাঁচ বোর্ডের পাঁচজন, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া থেকে পাঁচজন এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত পাঁচজন সমন্বয়ে মোট ১৫ জনের একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। এ সাব-কমিটির নাম দেয়া হয় ‘বাস্তবায়ন ও সমন্বয় সাব-কমিটি’। গত বুধবারের সভায় সাব-কমিটিতে আরো দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সাব-কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসানকে। গত বুধবারের সভার শুরুতে আল-হাইআতুল উলয়ার সদস্য, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি এবং মতিঝিল জামিয়া দ্বীনিয়া শামসুল উলুম পীরজঙ্গী মাজার মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা ছফিউল্লাহ (র.)-এর মাগফিরাত কামনা করা করে দোয়া করা হয়। এ ছাড়াও করোনা পরিস্থিতিতে দেশবাসীসহ বিশ্বমানবতার জন্য দোয়া করা হয়; উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানদের হয়রানি না করার জন্য এবং গ্রেপ্তার আলেম-উলামা ও সাধারণ মুসলমানদের দ্রুত মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানানো হয়।

জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় কওমি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রভর্তির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে, উগ্রপন্থি মানহাজিদের ভর্তি ঠেকাতে শহরের জামিয়া ইউনুছিয়া, দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া, জামিয়া সিরাজিয়া দারুল উলুমসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ছাত্র ভর্তির নোটিসেও হাটহাজারী মাদ্রাসার নির্দেশনাকে সামনে রেখে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কার্যক্রমে যুক্ত ছাত্রদের ভর্তি না নেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা সচিব মাওলানা শামসুল হকের সই করা জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জামিয়ায় অধ্যয়নরত অবস্থায় কোনো ছাত্রই রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক বা কোনো সংগঠনেই যুক্ত থাকতে পারবে না। এ ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডেও যুক্ত থাকতে পারবে না ছাত্ররা।

জানতে চাইলে দারুণ আরকাম মাদ্রাসার একজন সিনিয়র শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানই কেবল নয়, দেশের অন্য কওমি মাদ্রাসাগুলোতও ছাত্র ভর্তির বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে। দেশের জাতীয় সংস্কৃতিসমৃদ্ধ জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হচ্ছে নিয়মিত। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে নিয়মিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোতে নানা আয়োজন করা দারুল আরকামের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। ভবিষ্যতেও এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হবে।’

সিলেটের একটি কওমি মাদ্রাসার মুহতামিম জানান, কওমি মাদ্রাসায় উগ্রপন্থিদের বড় অংশটি নিয়মিত পড়াশোনায় পিছিয়ে রয়েছে। এদের অধিকাংশ বড় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও নিয়মিত পড়াশোনা ও পরীক্ষায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। সেক্ষেত্রে দাওরায়ে হাদিসসহ অন্যান্য ক্লাসে ভর্তির ক্ষেত্রে ভালো রেজাল্টের শর্ত দিয়েছে বিভিন্ন মাদ্রাসা।

দারুল আরকাম মাদ্রাসার গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ইফতা, আরবি সাহিত্য বিভাগে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষায় ন্যূনতম মুমতাজ (স্টার মার্ক) ও জায়্যিদ জিদ্দান (প্রথম শ্রেণি) প্রাপ্তি সাপেক্ষে ছাত্র ভর্তি করা হবে।

চট্টগ্রামের একাধিক আলেম জানান, উগ্রপন্থি মানহাজিদের উপস্থিতি ঠেকাতে চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান পটিয়া মাদ্রাসায় ইফতা বিভাগে চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা উবায়দুল্লাহ হামজা বলেন, ‘আমরা আপাতত এক বছরের জন্য ইফতা বিভাগ বন্ধ রেখেছি। তবে ফতোয়া (ইসলামি আচারবিধিবিষয়ক বিধান ও সমাধান) কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আগামী বছর আবারও নিয়মিত ভর্তি নেয়া হবে।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজনীতি,কওমি মাদ্রাসা,ছাত্র ভর্তি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close