বদরুল আলম মজুমদার

  ১০ জুন, ২০২১

শিক্ষার্থীদের বিদ্যাপীঠ

ক্যাম্পাসে ফিরতে অধীর আগ্রহ

করোনা মহামারির কারণে দেড় বছর বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। খোলার একাধিক তারিখ দেয়া হলেও খুলেনি প্রতিষ্ঠান। কবে খুলবে প্রিয় প্রাঙ্গণ তা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবার মাঝে বিরাজ করছে এক ধরনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। প্রাকপ্রাথমিক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরতে মুখিয়ে আছে। কিছুটা দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ছাত্রছাত্রীদের কাছে আনন্দদায়ক হলেও এমন বন্ধের জন্য তারা কখনই প্রস্তুত ছিল না। অবস্থা এমন, সেই বন্ধই যেন এখন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে।

এরই মধ্যে বাসায় বসেই কেটেছে একটি শিক্ষাবর্ষ। চলতি বছরের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে খুলবে করে আরেকটি শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক সময়ও অতিবাহিত হয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে তারও সঠিক সময় জানা নেই। কবে শেষ হবে এ মহামারি? এসব প্রশ্নেরও সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব নেই কারোর কাছেই। তাই দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা নানা অপরাধমূলক কার্মকান্ডে যেমন জড়িয়েছে আবার অনেকে মানসিকভাবেও বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতায় এক ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সারা দিন-রাত বাসায় থেকে মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ছে।এলোমেলো চিন্তা ভর করছে মাথায়। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কেউ কেউ অস্বাভাবিক আচার-আচরণ করে পারিবারিক শান্তিও নষ্ট করছে। সময় পার করতে শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট গেমসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। স্মার্টফোনের প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থী আপত্তিকর ভিডিও, টিকটক, লাইকিসহ নানা নিষিদ্ধ অ্যাপসের দিকেও ঝুঁকছে। অনেক শিক্ষার্থী আবার জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ে, ইয়াবা, হেরোইনসহ নানা মরণ নেশায়। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিবাবকরাও প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মায়ের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, এক বছর ধরে স্কুলে যেতে পারছে না তার মেয়ে। ফলে এই শিক্ষাবর্ষের অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত না হয়েই তাকে পরবর্তী ক্লাসে উঠতে হচ্ছে। স্কুলের সার্বিক পরিবেশ, অনেকগুলো বাচ্চার সঙ্গে মেশা ও শেখায় এক ধরনের পাঠচক্র থাকে। এখন বাসায় পড়ানোর চেষ্টা করলেও দেখা যায় তার আগ্রহ নেই। পরীক্ষা হচ্ছে না অনেক দিন ধরে। পরীক্ষা কীভাবে হয় সেটাই আসলে তার মনে নেই। পড়ার যে আগ্রহ সেটা অনেকটাই কমে গেছে। এমনকি তার আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। আমরা অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানাচ্ছি।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখায় একটা অনীহা চলে এসেছে। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্লাস ও পরীক্ষা না থাকায় তারা তাদের সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে পারছে না। ফলে তাদের মধ্যে একঘেয়েমি ভাব চলে এসেছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠও নেই, যেখানে তারা সময় কাটাবে। এমতাবস্থায় দিনে দিনে তারা মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের এ ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্প নেই বলে মনে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের এই অধ্যাপক।

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ও লেভেলের শিক্ষার্থী আদিবা ইসলাম। স্কুল বন্ধের সময়ে শিক্ষক বাসায় এসে পড়ালেও আগের মতো পড়াশোনা হয় না তার। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে পড়তেই বেশি ভালো লাগে। স্কুলের মাঠের হই-হুল্লোড় করে খেলাটাকে বেশি মনে করে সে। ফিরে যেতে চায় আবার স্কুলে। আদিবা প্রতিবেদককে জানায় ‘আগে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে পড়তাম। খুব সহজেই বুঝতাম পড়া। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম। এখন তা পারি না। আমি আবার স্কুলে যেতে চাই। ক্লাস করতে চাই বন্ধুদের সঙ্গে। কবে খুলবে স্কুল’।

রাজধানীর একটি প্রাইভেট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিনুর জামান। স্কুল বন্ধের এই সময়ে অনলাইন ক্লাস করে নিজেকে পড়াশোনার সঙ্গে সংযুক্ত রেখেছে সে। কিন্তু মন পড়ে থাকে স্কুলে। বাসার ছাদে থেকে বাইরের প্রকৃতি দেখতে আর ভালো লাগে না তার। যেতে চায় স্কুলে। একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী অরণি পাল। স্কুল বন্ধে বাসায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কখনো টিভি দেখে, কখনো খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটে তার। এভাবে সময় কাটাতে আর ভালো লাগছে না। ফিরে যেতে চায় স্কুলের মাঠে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহান শাহরিয়ার অপি প্রতিবেদককে বলেন, বাসায় থাকতে আর কত ভালো লাগে। গেমস খেলে সময় পার করি। বাইরে বেরুতে পারি না। দীর্ঘদিন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা ও কথা হয় না। মনটা বিষাদে ভরে গেছে। আমরা অবিলম্বে ক্লাসে ফিরতে চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয় লাইফের সেমিস্টারই শুরু হয়েছে অনলাইনে। ক্যাম্পাসের আমেজ কি তা এখনো আমার অজানা। তাই আমি চাই, যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয় খুলুক। তিনি তার ক্লাসের কার্যক্রম সশরীরে উপভোগ করতে চান।

ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জেরিন হাছান কান্তা বলেন, দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে যেতে পারি না। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হয় না। ভালো লাগে না। আমরা ক্যাম্পাসে যেতে চাই।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘চলমান সমস্যা বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। প্রত্যেক জাতিই নিজস্ব সুবিধা ও পদ্ধতি অনুযায়ী উত্তরণের কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরাও করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। দূরশিক্ষণ ও অনলাইন পদ্ধতিতে পাঠদান চলছে।

তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বন্ধ এমনটা মানতে নারাজ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, শিক্ষার্থীদের উচিত তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া। কারণ তাদের সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কেবল পাস করার জন্যই লেখাপড়া নয়। তাদের অবশ্যই জ্ঞানার্জন করতে হবে।

নওয়াব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনুর মিয়া প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সবকিছুই চলছে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে শিক্ষার্থীরা অনেক যোজন যোজন পিছিয়ে পড়বে। যা ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ক্যাম্পাস,শিক্ষার্থী,বিদ্যাপীঠ,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close