নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলু
দৃষ্টিপাত
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে করণীয়
শিক্ষার মূলভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা, আরো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। শিক্ষা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা হচ্ছে শিক্ষা মানুষের চিন্তার উৎকর্ষ ও অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোকে বিকশিত করে। আর যে শিক্ষা বোধসম্পন্ন মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং যার মাধ্যমে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটে তা মানসম্মত শিক্ষা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কঠিন সময়ে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণ করেন। তার মৃত্যুর ২১ বছর পর শেখ হাসিনা সরকার ২০১৩ সালে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন।
সম্প্রতি ৭২তম জাতিসংঘ অধিবেশনে শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুরস্কৃত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত শিক্ষায় বৈষম্য হ্রাস, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা প্রভৃতি খাতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি এ পুরস্কার পান। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নতরাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণিত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৪ নম্বর অভীষ্ট হলো মানসম্মত শিক্ষা (অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা)।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন একটি চলমান ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। গত কয়েক বছরের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। ১. প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ প্রদান। ২. হাওর-চর, পাহাড়ি, দুর্গম এলাকা, চা-বাগান, জেলেপল্লী, বস্তিবাসী ছেলেমেয়েসহ ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তীকরণ। ৩. সব শ্রেণির/ধরনের শিশুদের ‘একীভূত শিক্ষা-সেল’ গঠন। ৪. বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি বিনামূল্যে শতভাগ বই বিতরণ করে বই উৎসব পালন। ৫. শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদান। ৬. স্লিপ বরাদ্দ থেকে ছাত্রছাত্রীদের ড্রেস, খাতা-কলমের ব্যবস্থা। ৭. উদ্ভাবনী বিভিন্ন কার্যক্রম। ৮. শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। ৯. মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ, হোমভিজিট ও উঠান বৈঠক। ১০. বিদ্যালয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কক্ষটি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এমনকি আলাদাভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১১. প্রায় সব বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ। ১২. অধিকাংশ বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট/ওয়াইফাই সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ১৩. অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক মনিটরিংয়ের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান। ১৪. কর্মকর্তারা ই-মনিটরিং ভিজিট এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ ভিজিট করেন। ১৫. দৃষ্টিনন্দন ভবন তৈরি, মেরামত, ক্ষুদ্র মেরামত ইত্যাদি বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা এবং চলমান, যা বলে শেষ করার মতো না।
তবু বাংলাদেশে সর্বজনীন ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে রয়েছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার মূল কাজটি হয়ে থাকে শ্রেণিকক্ষে। শ্রেণিকক্ষকে বিবেচনায় এনে তিনটি ক্ষেত্র হলো। ক. শিক্ষক, খ. শিক্ষার্থী ও গ. শ্রেণিকক্ষ। এই ক্ষেত্র তিনটি যত স্বচ্ছ হবে কারিকুলাম ডিজমিনেশন তত স্বচ্ছ হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন হলো অভিভাবকের সচেতনতা। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে তৃণমূল পর্যায়ে যে শিক্ষকরা কাজ করেন তাদের কিছু বিষয় আমার দৃষ্টিগোচর হয়।
যেমন:
ক. মেধাবী শিক্ষকের অভাব : বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বেশি হওয়ায় অন্য কোনো চাকরি না পেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে হতাশা নিয়ে কাজ শুরু করে। ভালো কোথাও সুযোগ পেলে মেধাবীরা চলে যায়। তাই শুরুতেই একটা সম্মানজনক গ্রেড প্রদান করলে ভালো অর্থাৎ মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকত।
খ. একই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত থাকা : অন্যান্য পেশায় তিন বছর অন্তর বদলির নিয়ম থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষকদের এমন নিয়ম নেই। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে একঘেয়েমি কাজ করে। ফলে পাঠদানে প্রভাব পড়ে। তাই অন্তত ৫-৬ বছর পর বদলির ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়।
গ. পাঠদানবহির্ভূত কাজ : শিক্ষকদের মূল কাজ হলো পাঠদান। কিন্তু তা না করে পাঠদানবহির্ভূত নানামুখী কাজে তাদের সম্পৃক্ত করা হয়, ফলে কাক্সিক্ষত সেবা পেতে ব্যর্থ হয় জাতি।
ঘ. সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ পুনরায় চালু করা জরুরি। কারণ এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের একঘেয়েমি দূর হয়। বিগত দিনের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের সুযোগ পায়।
ঙ. কিছু কিছু বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলে, যা মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায়। আবার সিনিয়ররা এক গ্রুপ, জুনিয়ররা অন্য গ্রুপ হয়ে দলাদলি করে বিদ্যালয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চ. অনেক শিক্ষকই কারিকুলাম সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা রাখেন। এজন্য শিগগিরই প্রশিক্ষণ চালু হবে বলে আশাকরি।
ছ. শিক্ষকরা আন্তরিক নয় বিধায় তাদের বই পড়ায় অনীহা, যা হতাশার। মূলত পাঠদানবহির্ভূত কাজে সম্পৃক্ত থাকতে থাকতে পাঠ্যপুস্তকের পাঠটি আত্মস্থ করতে তারা উদাসীন। এজন্য শিক্ষকদের মানসিকতা উন্নত করা জরুরি। শিক্ষকদের এটি মাথায় রাখতে হবে শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয় বরং শিক্ষকতা মানে সেবা প্রদান।
জ. চারু/কারু/সংগীত শিক্ষক : প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষকের অনেকগুলো ক্লাস নিতে হয়, তাই সবগুলো বিষয়ের ওপর ধারণা থাকতে হয়, যা আসলেই কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে চারু/কারু ও সংগীতের আলাদা শিক্ষক প্রয়োজন।
ঝ. আইসিটি শিক্ষক এবং করণিক নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা থাকার কারণে এরা যখন উপবৃত্তি বা সিআরভিএসের কাজ করতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে তখন ক্লাস খালি থাকে, পাঠদান ব্যাহত হয়।
তবে শিক্ষকদের মানসিকতা উন্নত করা জরুরি। বেশির ভাগ শিক্ষকের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। এরা রাজনীতি, বিচার-সালিস, কোচিং-বাণিজ্য এসবে কম আগ্রহী হয়ে যদি পাঠ-পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঠদান করে তাহলে মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন সহজ হয়। আমার মতে, পুরো চাকরিজীবনে একটিও পদোন্নতি না পেয়ে অবসর গ্রহণ, দীর্ঘদিন একই গ্রেডে চাকরি করা শিক্ষক এমনকি কর্মকর্তাদেরও হতাশ করে ফেলেছে। দ্রুতগতির পদোন্নতি এ ক্ষেত্রে সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করত বলে আশা করি। এবার আসি শিক্ষার্থীদের কথায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় অনেকটাই নিয়মিত হয়েছে। গুটি কয়েক শিক্ষার্থী ছাড়া বেশির ভাগই স্কুলে উপস্থিত থাকে, বর্তমান সরকারের মেয়াদে শিশুদের ঝরে পড়ার হারও কমেছে শুধু কিছু অভিভাবকের অসচেতনতা এবং তাদের স্ট্যাটাস মেনটেইনের জন্য কেজি স্কুলপ্রীতি সরকারি প্রাথমিকগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পরিতাপের বিষয় হলো, কর্মকর্তাদের সূক্ষ্ম মনিটরিং সত্ত্বেও শত চেষ্টায়ও কোভিড-১৯-এ পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের গ্যাপ এখনো পূরণ করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো স্কুলের ৬টি ক্লাসের মধ্যে ৩টি ক্লাসও যদি আনন্দদায়ক হয় তাহলে শিশুরা বিদ্যালয়বিমুখ হবে না।
শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে শুধু ভালো নম্বর ও গ্রেড পেলে হবে না, পাশাপাশি নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। শিক্ষা মানে শুধু অর্থকরী কাজ বা চাকরির জন্য কিছু মানবযন্ত্র উৎপাদন নয়। আমরা যদি চিত্রকর, সংগীতশিল্পী ও ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলায় তারকাদের সম্পর্কে খোঁজ নিই, তাহলে দেখব তারা শিশুকাল থেকেই ওইসব বিষয়ে আগ্রহী ছিল। তাই কোনো শিশু কীসে আগ্রহী সেসব বিবেচনা করে তার শিক্ষাদান করা জরুরি। কাউকেই ছোট করে দেখা যাবে না। প্রতিটি শিশুকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুদের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে মায়ের সচেতনতা, আন্তরিকতা এবং বিদ্যালয়ের সঙ্গে মায়ের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক এমনকি সেরা মায়ের স্বীকৃতি প্রভৃতি গঠনমূলক পদক্ষেপ প্রহণ করা জরুরি।
কোনো কোনো বিদ্যালয়ে গেলে শিশুদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারি তারা না খেয়ে বিদ্যালয়ে এসেছে, দেখা যায় তারা হতদরিদ্র বলে না খেয়ে আসে না বরং মা ঘরের অন্যান্য কাজ করে সময় পায়নি তাদের খাবার রেডি করতে। এ ক্ষেত্রে সরকর কর্তৃক চালুকৃত মিড-ডে মিলের সময় ওই মায়েরা বিদ্যালয়ে এসে খাবার দিয়ে যেতে দেখেছি। সুতরাং শিশুর শারীরিক বিকাশে অভিভাবককে সচেতন করতে কথা বলতে হবে। কারণ খালি পেটে মস্তিষ্ক কাজ করে না। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফলের পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হলো আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য দক্ষ শিক্ষক, যথার্থ শিখন পদ্ধতি, কার্যকর বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি।
একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী না হতেন তাহলে তিনি কী হতে চাইতেন। জবাবে তিনি বলেন, ছোটবেলায় তার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে প্রাথামিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কর্মকর্তা তদুপরি আমার মতো জনপ্রতিনিধিরা যদি নিজ নিজ অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে তাহলেই মাসসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন সফল হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ, নবাবগঞ্জ, সহসভাপতি, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ
পিডিএস/আরডি