সম্পাদকীয়
সেই শোক সইবার নয়
‘তোরা কী চাস?’ ‘কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসীম সাহসের অধিকারী ছিলেন, তা এই প্রশ্ন দুটি থেকেই বোঝা যায়। তিনি যেভাবে হুঙ্কার দিয়ে পাকিস্তানিদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছিলেন, সেভাবেই মৃত্যুর আগমুহূর্তেও ঘাতকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়েছিলেন। ঘাতকদের হুঙ্কার দেওয়া মূলত মৃত্যুকেই হুঙ্কার দেওয়া। বঙ্গবন্ধু কারো রক্তচক্ষু বা মৃত্যুকে পরোয়া করতেন না। তাই যদি করতেন তাহলে কি আমরা পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া তো দূরের কথা স্বাধীন দেশের স্বপ্নও দেখতে পারতাম?
অথচ সেই বাঙালিই কি না তার স্বপ্নদ্রষ্টাকে রক্ষা করতে পারল না! যে বুকে বাংলার মানুষের জন্য প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিল, সেই বুকটাই ঝাঁজরা করে দিল তারই প্রিয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু দুর্বৃত্ত। বঙ্গবন্ধু কোনো দিন বিশ্বাসই করেননি, বাংলাদেশের কোনো মানুষ তাকে মারতে পারে বা কোনো ক্ষতি করতে পারে। পৃথিবীর অনেক নেতাই তাকে এ বিষয়ে সতর্কও করেছিলেন। কিন্তু বাঙালিদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ছিল বলে সেই আশঙ্কার কথা হেসে উড়িয়ে দিলেছিলেন, বলেছিলেন, ‘ওরা তো আমার ছেলে, আমাকে কেন মারবে?’ এত বড় বিশ্বাস ভঙ্গ করে তারাই বাঙালির ললাটে কলঙ্ক লেপন করে দিল। কী নির্মমতা! ভাবা যায়?
বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাসংগ্রাম শেষে যখন ক্ষতবিক্ষত অবস্থা থেকে দেশটির পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, ঠিক তখনই ঘটানো হয় ইতিহাসের এই নির্মম ঘটনা—পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষতবিক্ষত দেশটির মতোই বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধুর বুককেও করা হয় ক্ষতবিক্ষত। সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ ও মেয়ে বেবি, সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ ঘনিষ্ঠজনরা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহলের হাত থেকে।
আজকের দিনটি সেই দিন, বাঙালির শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলা রচিত হয় ইতিহাসের এই কলঙ্কিত কালো দিনটি- শোকাবহ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। প্রতি বছর দিনটি আসে বাঙালির হৃদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে। পুরো জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করে। সেই শোক কি সইবার মতো, যা বাঙালি বয়ে বেড়াচ্ছে বুকে! তবু বাঙালি সেই শোক বুকে নিয়ে; সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে এগিয়ে চলছে আগামীর পথে।
আজ শোকের দিনে জাতির পিতাসহ তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমরা তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। পিতাকে হারানোর শোক বুকে নিয়ে বাঙালি জাতি একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সচেষ্ট থাকবে, সেই প্রত্যাশা আমাদের।