লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রেষণে কুয়েতে নিযুক্ত
ডেঙ্গু সংক্রমণে শিশুরা অধিক ঝুঁকিতে
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১০টিরও বেশি দেশে ডেঙ্গু মহামারির রূপ নিয়েছে। বছরে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে এটি সংক্রামিত হয়, যার মধ্যে ৫ লক্ষ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং প্রায় ১২৫০০-২৫০০০ জনের মৃত্যু ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে গত ৫০ বছরে ডেঙ্গু জ্বর বেড়েছে ৩০ গুন।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০০০ সালে। সে বছর ৫,৫০০ জন সংক্রমিত হয়েছিল, মারা যায় ৯৩ জন। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম ছিল। তবে ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১০৫ জন। ২০২২ সালে দেশে ৮ হাজার ১৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবগুলো জেলায় আশঙ্কাজনকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর দেশে যত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। সারা দেশের ডেঙ্গু আক্রান্তের ৬০% ঢাকার। দেশে ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১২ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রায় তিন হাজার মানুষ এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছে ৯ হাজারের বেশি রোগী। আগামী দুই মাস ডেঙ্গু আরও বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত যতজন মারা গেছে তার প্রায় ২৫ ভাগ শিশু। শিশুদের মধ্যে এই রোগ সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকার কারণ, তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এছাড়া ডেঙ্গু পরিবহনকারী মশারা দিনের বেলায় কামড়ায়; এ সময় শিশুরা স্কুলে থাকে, মাঠে খেলা করে বা এখানে ওখানে বসে টিফিন খায়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ডেঙ্গুতে শিশুদের অবস্থা বেশি নাজুক। শিশুদের ডেঙ্গুর লক্ষণ বুঝতে দেরি হওয়ায় দেরিতে হাসপাতালে নেয়ার কারণে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণের ফলে শিশুরা অল্পতেই শকে চলে যায়। কিডনি, লিভার ফেইলিওর শিশুদের খুব দ্রুত হয়। সে কারণে ডেঙ্গুতে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি।
ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ ঘটে। এ মশার গায়ে সাদা রঙের ডোরাকাটা দাগ থাকে বলে অন্য মশা থেকে এটাকে সহজেই আলাদা করা সম্ভব। সাধারণত দিনের বেলায় এডিস মশা কামড়ায়। ভোরে বা সূর্য উঠার ৩-৪ ঘণ্টা পর এবং বিকেল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত এ মশা অধিক সক্রিয় থাকে, রাতে এরা বিশ্রাম নেয়; তখন কামড়ায় না। তবে অনেকের মতে শুধু দিনের বেলা নয়, এডিস মশা সক্রিয় হয় উজ্বল আলোতে, তাই ঘর আলোকিত থাকলে রাতেও এরা কামড়াতে পারে।
জমে থাকা পরিস্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পারে। ডিম দেয়ার জন্য এডিস মশার পছন্দের জায়গা ১৯টি। সেগুলো হলো পুরোনো টায়ার, লন্ড্রি ট্যাংক, ঢাকনাবিহীন চৌবাচ্চা, ড্রাম বা ব্যারেল, অন্যান্য জলাধার, পোষা প্রাণীর পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের ব্লক, ফেলে রাখা বোতল ও টিনের ক্যান, গাছের ও বাঁশের ফোকর, দেয়ালে ঝুলে থাকা বোতল, পুরোনো জুতা, ফুলের টব, পরিত্যক্ত খেলনা, অঙ্কুরোদগমরত উদ্ভিদ, বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্র, ইটের গর্ত ও অপরিচ্ছন্ন সুইমিং পুল। তবে পানি জমে থাকা যে কোনো জায়গায় এরা ডিম দিতে পারে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন থাকে, যথাঃ DEN-1, DEN-2, DEN-3 ও DEN-4 । একটি ভাইরাস যদি একবার আক্রমণ করে, সে ভাইরাস দিয়ে পরে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তবে দ্বিতীয়বার যে ডেঙ্গু সংক্রমন করে তা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। অনেক সময় কোন শিশু কতবার আক্রান্ত হয়েছে, তা বোঝার উপায় থাকেনা। কারণ, অনেক সময় দেখা যায়, শিশু জ্বরের লক্ষণ নিয়ে আসলেও ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়না। পরীক্ষা না করলে আসলে উপসর্গ দিয়ে শত ভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো সকলের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম। সাধারণত, সংক্রমণের ৩-১৪ দিন পরে উপসর্গ দেখা দেয় । ডেঙ্গুর জ্বরকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়ে থাকে।
প্রথম জ্বর পর্যায় - শিশুর ডেঙ্গু জ্বর ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়ে থাকে। উচ্চ মাত্রার জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশি ও জয়েন্টের ব্যথা এ সময় ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম লক্ষণ, গায়ে র্যাশও দেখা দিতে পারে। এ পর্যায়ে বেশিরভাগই এক সপ্তাহ পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ ধরণের ডেঙ্গুকে ক্লাসিক ডেঙ্গু বলা হয়ে থাকে। সাধারণ বা ক্লাসি্ক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ১ শতাংশেরও কম রোগীর অবস্থা মারাত্মক হতে পারে।
দ্বিতীয় জ্বরহীন পর্যায় - সাধারণত এ সময় শিশুর জ্বর থাকে না, সময়কাল থাকে ২-৩ দিন । কিন্তু এ সময়ে শিশুর জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর রোগটি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। রোগীর রক্ত থেকে প্লাজমা বের হয়ে বিভিন্ন অংশে জমা হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে রক্ত ও অঙ্গাণুসমুহে জটিলতার সৃষ্টি হয়, রক্তপাত ঘটে, শরীরের রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যেতে পারে; একে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ২.৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়। যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দেয় এবং শিশু শকে চলে যেতে পারে, যাতে মৃত্যুহার ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তাই জ্বর সেরে যাওয়ার দুই থেকে তিন দিন শিশুকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।
তৃতীয় নিরাময় পর্যায়ের সময়কাল ৪-৫ দিন, এ সময় শিশুর শরীরে রিকভারি র্যাশ দেখা দিতে পারে।
তবে, লক্ষণীয় যে, ডেংঙ্গু আক্রান্ত শিশুর মধ্যে স্বাভাবিক চঞ্চলতা থাকে না; শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং ঝিমাতে থাকে এবং অযথা কান্নাকাটি করে। শিশুর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, কিছুই খেতে চায় না। বমি বমি ভাব হয় বা কিছু খেলেই বমি করে দেয়। ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে শিশুর প্রস্রাব না হওয়া ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণের অন্যতম। ডেঙ্গুর কারণে শিশুর পেট ফুলে যেতে পারে বা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং শকে চলে যেতে পারে।
শিশুর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলে, চিকিৎসকরা সাধারণত কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি), এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন, এফজিপিটি এবং এফজিওটি প্রভৃতি পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। ডেঙ্গু হলেই যে শিশুকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে বিষয়টা এমনটা নয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলে বাড়িতে রেখেও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। শিশুর মধ্যে যদি বিপদ চিহ্ন দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকরাই তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণের মতে, ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে, প্লাটিলেট কমে গেলেই কেবল রোগী খারাপ হয়ে যাবে; তাই তারা অনেক সময় প্লাটিলেট ভালো থাকলে রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে চায় না। প্লাটিলেটের সংখ্যা ডেঙ্গু রোগী ভাল/খারাপ হওযার একটি সূচক মাত্র । ডেঙ্গু রোগী সন্দেহ হলে প্লাটিলেটের পাশাপাশি সাধারণত সিবিসি পরীক্ষা করে অথাৎ সম্পূর্ণ শ্বেতকণিকা, রক্তের তরল অংশ ও কনিকাগুলোর অনুপাত বা হেমাটোক্রিট ইত্যাদি দেখে ডেংঙ্গু আক্রান্ত শিশুর সার্বিক অবস্থা বোঝা যায়। অনেক সময় প্লাটিলেট ভালো থাকা রোগী খারাপ হয়ে যেতে পারে, আবার প্লাটিলেট খুব কম থাকা রোগীও ভাল হয়ে যায় ।
ডেংঙ্গু আক্রান্ত শিশুর আবাসিক ব্যবস্থাপনা
• শিশুর গায়ে জ্বর থাকলে, পানি দিয়ে শরীরে বার বার স্পঞ্জ করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
• শিশুকে পানি ও মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি বেশি পরিমাণে তরল খাবার, বিশেষ করে খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের শরবত, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে।
• ডেঙ্গু আক্রান্ত কাউকে এডিস মশা কামড়ানোর পর অন্যকে কামড়ালে তার শরীরেও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই ডেংঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে সব সময় মশারির ভেতরে রাখতে হবে।
• বাইরে বের হলে শিশুদের গায়ে কয়েক ঘণ্টা অন্তর অন্তর মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে ।
• শিশুদের ফুল হাতা ও ফুল প্যান্ট পড়িয়ে রাখা মশার কামড় প্রতিরোধে কার্যকরী।ডেংগু আক্রান্ত শিশুর হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা
সন্দেহজনক ডেংঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে দ্রুত শিশু বিশেষজ্ঞ বা জেনারেল ফিজিসিয়ানের কাছে নিয়ে, তাদের পরামর্শ মত প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। হাসপাতালে সাধারণত নিম্নোক্ত চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে।
• ডেঙ্গুর ধরণ বুঝে শিশুদের প্যারাসিটামল অথবা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়া হতে পারে।
• রক্তচাপ অস্বাভাবিক থাকলে স্যালাইন দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
• রোগীর শক সিনড্রোম বা রক্তক্ষরণের উপসর্গ থাকলে স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরে অ্যালবোমিন প্রয়োগ করা হতে পারে। রক্ত দেয়ারও প্রয়োজন হতে পারে ।
• শিশুর রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা যদি ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ এর নীচে চলে আসে বা রক্তরক্ষণ হয়, তাহলে শিশুকে প্লাটিলেট দেয়ার প্রয়োজন হয় ।মশার বংশ বৃদ্ধি, কামড় ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়
• বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে ।
• এডিস মশা সাধারণত টায়ার, ব্যারেল, প্লাস্টিকের ড্রাম ও জেরিকেনের মধ্যে জমা পরিস্কার পানিতে বংশবৃদ্ধি করা পছন্দ করে। এছাড়া এদের বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ আউটডোর স্থান গুলো হচ্ছে - ব্যাল্কোনিতে থাকা গাছের পাত্র, এসির ট্রে, মাটির পাত্র ইত্যাদি; ইনডোরে ফ্রিজের ট্রে, রান্নাঘরের র্যাক, রান্নাঘরের / বাথরুমের পানি জমে থাকা ড্রেন, কুলার, বাথরুম বা সিস্টার্নে থাকা লিকেজ, অব্যবহৃত খোলা বালতি/পানির পাত্র, ঘর সাজানোর ফুলের টব / বনসাই প্ল্যান্ট টব / ইনডোর প্ল্যান্ট টব ইত্যাদি। ঘরের ভেতরে বা বাইরে থাকা এসব স্থান দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলুন এবং জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করুন। যে পানিতে এডিস মশা ডিম দিয়েছে, তা ফেলে দিলেই ডিম ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া সে পানিতে তেল ঢেলে, সাবান দিয়ে কিংবা ভিনেগার মিশিয়ে ডিম ধ্বংস করা যায়।
• মশা নিধনের জন্য একদিন অন্তর অন্তর স্প্রে বা ফগিং করুন ।
• বাইরে যাওয়ার সময় মশা প্রতিরোধী ক্রিম ব্যবহার করুন ।
• ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার আবশ্যক। এডিস মশা যেহেতু দিনের বেলা কামড়ায়, তাই দিনের বেলা ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমানোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।
• মশা প্রতিরোধী অ্যারোসল, কয়েল বা ফাস্ট কার্ড শিশুসহ সবার জন্য ক্ষতিকর; এর পরিবর্তে মসকুইটো কিলার বাল্ব, ল্যাম্প, কয়েল, কিলার ব্যাট, রেপেলার মেশিন, কিলার ট্র্যাপ ইত্যাদির ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপদে মশার প্রতিরোধ করা যেতে পারে ।