লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, কুয়েতে প্রেষণে নিযুক্ত

  ০৩ জুন, ২০২৩

কুয়েত কথন : ১১তম পর্ব

আরব দেশে মরুঝড়

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

পৃথিবীর মানচিত্রে অন্যতম বৃহৎ উপদ্বীপ আরবের আয়তন প্রায় দেড় মিলিয়ন বর্গমাইল। গোবি ও পারস্য মরুভূমি, সাহারার কিছু অংশ ও এশিয়ার মরুতট মিলে বলা চলে আরব অবয়বে সিংহভাগই মরুভূমি।

আরবের মরুভূমিগুলো মূলত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রথমত, মধ্যভাগের সুবিশাল মরু অঞ্চল । শীতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে এখানে চারণ ভূমির সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, উত্তরাঞ্চলের মরুভূমিতে মৌসুমী বৃষ্টিপাত হলেও গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমে জনহীন প্রান্তরে পরিণত হয়। তৃতীয় মরু অঞ্চলের অবস্থান উত্তর থেকে পূর্ব হাওরান পর্যন্ত। ঐতিহাসিকদের মতে এখানে ১২৫৬ সালে শেষ অগ্নুৎপাত ঘটেছিল।

মরুভূমি আরব জাতির শুধু আবাসভূমি নয়, এর সাথে মিশে আছে তাদের ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা ও নিরাপত্তাসহ জীবনের নানা বিষয়। যুগে যুগে এ মরুভূমি বহি:শত্রুর আগ্রাসন ও আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়। খাবারের অপ্রাচুর্য থাকলেও বিপন্ন অবস্থায় বিশ্বস্ত বন্ধু হয়েছে বারংবার। মরুভূমির কারণেই বহি:শত্রুর কাছে আরবরা খুব কমই মাথা নত করেছে।

তবে স্বাভাবিক সময়ে পানির অভাব, তাপদাহ, দিশাহীনতা কিংবা মরুঝড়কে মোকাবেলা করতে হয় পুরো আরব বিশ্ব এবং এখানে অবস্থানরত প্রবাসীদের; বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের এ সময় দু:সহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কারণ বেশির ভাগ এ অদক্ষ শ্রমিকের সিংহভাগই মরুভূমি, সড়ক ও মহাসড়ক এবং নতুন স্থাপনা নির্মাণস্থলে কাজ করতে দেখা যায়।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (WMO) মতে মরু ঝড়ের উৎপত্তির আবহাওয়াগত পদ্ধতি ও কারণ অন্যান্য ঝড়ের মত প্রায় একই, তবে ঝড়ো বাতাসে বালি ও ধূলিকনার উপস্থিতি এবং এ কারণে প্রায় ১০০০ মিটারে অধিক দূরত্বে দৃশ্যমান না হওয়া ইত্যাদি মরুঝড়ের বৈশিষ্ট। WMO তাদের ভাষায় একে বালি ও ধূলিঝড় (Sand and dust storm বা সংক্ষেপে SDS) হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। তাদের মতে এসব ঝড় ৭৫% প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে, শতকরা ২৫ ভাগ মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দায়ী, যেমন অপরিকল্পিত পানি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, জনসংখ্যার চাপ, খনিজ সম্পদ আহরণে অব্যবস্থাপনা, মরু পর্যটন ও মরুভূমিতে সামরিক মহড়া ইত্যাদি অন্যতম।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বসন্তের শেষ সময় থেকে পুরো গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ বছরের মে মাসের শুরু থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মরুঝড়ের প্রকোপ থাকে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মরুঝড়ের কবলে পড়ে ইরাকের উত্তরাংশে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর মধ্যভাগের মরু অঞ্চলে; তবে সৌদি আরব ও ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এলাকায়ও এর প্রবল প্রকোপ দেখা যায়। সৌদি আরবে বছরে প্রায় একশত বার ও প্রতিমাসে গড়ে ৩-৫ বার মরুঝড়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে। WMO এর পরিসংখ্যান মোতাবেক মরুঝড়ে প্রতিবছর প্রায় ২০০০ টন ধূলিবালি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে, যার বেশির ভাগ ঘটে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে।

মরুঝড় অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের মতই আক্রান্ত এলাকার পরিবেশ, কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, পশু সম্পদ, খাদ্য উৎপাদন, যোগাযোগ খাতে প্রভূত ক্ষতিসাধন করে থাকে। জাতিসংঘের হিসেবে মরুঝড়ে বিশ্বব্যাপি প্রতিবছর প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার পরিমাণের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন ঘটে।

বাংলাদেশের সিংহভাগ ও অন্যান্য দেশের অদক্ষ শ্রমিকদের বেশির ভাগ মরুভূমি, নতুন নির্মাণাধীন অঞ্চল ও সড়ক ও মহাসড়কে কাজে নিয়োজিত থাকে। মরুঝড় তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপুর্ণ। মরুঝড় কবলিত মানুষের দেহে বাতাসে মিশ্রিত ধূলিকনা শ্বাসের মাধ্যমে রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ধূলিকনার সাথে বিভিন্ন রোগ জীবাণু যথা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস ও জীবাণুর স্পোরসমূহ শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের দেহে শ্বাসতন্ত্রের রোগ যথা: হাঁপানি, নিউমোনিয়া, সিলিকোসিস প্রভৃতি রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা যায়। এছাড়া হৃদরোগ, চোখের সংক্রমণ, চর্মরোগ ও মেনিনজাইটিস রোগেও আক্রান্ত হতে দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে প্রকাশ করেছে যে, মরুঝড় উপদ্রুত এলাকার হাসপাতালগুলোতে হৃদরোগীর হার ২০-৭০%, ফুসফুস সংক্রমণের হার ২০-৩০% বেড়ে যায়। সাহারা অঞ্চলের মরুঝড়ের ধূলিতে মেনিনজাইটিস রোগ জীবাণু বহনের ফলে এতদঞ্চলে প্রতি বছর ঘাতক এ রেগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লক্ষের উপর।

তবে মরুঝড় যে শুধু ক্ষতি করে তা নয়; এটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈশ্বিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের বহুবিধ উপকার সাধনও করে থাকে। মরু ঝড় বৈশ্বিক ক্ষতিকর বিকিরণ ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে, বিভিন্ন অঞ্চলের মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে ও সমুদ্রের পানির পরিবেশ রক্ষার অন্যতম উপাদান ফাইটোপ্লাংটন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উপাদান পরিবহণ ও সরবরাহে ভূমিকা রাখে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরব,মরুঝড়
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close