লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, কুয়েতে প্রেষণে নিযুক্ত

  ২৩ মে, ২০২৩

কুয়েত কথন : ১০ম পর্ব

সৃজনশীল স্থাপত্য কুয়েত টাওয়ার 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

তেল সমৃদ্ধ কুয়েত মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম ধনী দেশ, তাতে সন্দেহ নেই। ১৭৫২ সাল থেকে আল কুয়াইত ( Al Kuwyat) নামক নিরাপত্তা দূর্গের নাম থেকে কুয়েত হওয়া এ দেশটি বিভিন্ন কারণে সারা বিশ্বে পরিচিত। বিশ্বে বোধ হয় কুয়েতই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রবাসীর সংখ্যা দেশের নাগরিকের চাইতে প্রায় দ্বিগুন; যাদের প্রায় শতভাগেরই জীবিকার সন্ধানে এদেশটিতে আগমন। আরব জাতির ইতিহাসে একখণ্ড মরু অঞ্চল আজ ঐতিহ্য ও অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার সমৃদ্ধিতে উৎকর্ষতার শীর্ষে পৌঁছতে বাকী নেই।

মরু অধ্যূষিত দেশ সমূহে সুপেয় পানির অভাব সে প্রাচীনকাল থেকেই। পারিবারিক, বংশগত বা ব্যসায়িক কাফেলা যাত্রায় কিংবা বাসস্থানে পানিই ছিল বলা চলে সবচেয়ে মুল্যবান বস্তু। কাফেলা সমূহের যাত্রা বিরতিতে পানির সংরক্ষণাগারে নিরাপত্তা প্রহরী নিযুক্ত করা হতো।

পেট্রোলিয়াম পরবর্তী কালে; ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬২ সাল থেকে দেশটিতে জনগণের পানি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে দেশব্যাপি ৩৪টি বৃহৎ আকারের ওয়াটার টাওয়ার নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পটির দায়িত্ব পায় সুইডিশ প্রকৌশল কোম্পানি (সুইকো) ও ভেটন বিগান্দবিজান (ভিবিবি) কোম্পানি। কোম্পানির প্রধান আর্কিটেক্ট দম্পতি মেলেন জর্ন ও সুন ল্যান্ডস্ট্রম প্রজেক্টের নকশা পরিকল্পনা করেন এবং ১৯৭১ সালে তা অনুমোদিত হয়। দেশব্যাপী ৬টি নির্মিতব্য পানি সংরক্ষণাগারের নকশা ‘মাশরুম’ আকৃতির নকশা অনুমোদিত হলেও রাজধানীর উপকণ্ঠে পারস্য উপসাগর তীরে নির্মিয়মান ৬ষ্ঠ গুচ্ছের আরও আকর্ষণীয় নকশার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তৎকালীন আমির ও আধুনিক কুয়েতের প্রবক্তা শেখ জাবের আল আহমেদ আল সাবাহ। এ প্রেক্ষিতে দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত টিম ১০টি ভিন্ন নকশা উপস্থাপন করে। অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ওরুচিশীল আমির আধুনিক ও অর্থবহ এ নকশাটি চূড়ান্ত করেন। বেলগ্রেড ভিত্তিক ইউনিয়ন-আইজেনজারিং কোম্পানি এ স্থাপত্যসমূহের নির্মাণ কাজ শেষ করে ১৯৭৫-৭৬ সালে। কাজ সমাপ্তির পর এ আবরাজ আল কুয়েত বা বুর্জান আল কুয়েত উদ্বোধন করা হয় ১৯৭৯ সালে; যা আধুনিক কুয়েতের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে এবং কুয়েত টাওয়ার হিসেবে সমাধিক পরিচিত।

কুয়েত টাওয়ার্স মূলত তিনটি টাওয়ারের সমষ্টি। প্রথমটির উচ্চতা ১৮৭ মিটার, যা ২টি গোলকের সমন্বয়ে গঠিত, ২য়টিতে একটি গোলক, যার উচ্চতা ১৪৭ মিটার; গোলকবিহীন ৩য় টাওয়ারটি বৈদ্যুতিক ও রক্ষণাবেক্ষণ স্টোর হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।

প্রথম টাওয়ারের নীচের গোলকটি দু'টি অংশে বিভক্ত; নিম্নাংশে ৪৫০০ ঘনমিটার পানি সংরক্ষণাগার, উপরের অংশে একত্রে ৯০ জনের ব্যবহার উপযোগী রেস্টুরেন্ট, একটি ক্যাফে, অভ্যর্থনা হল এ লাউঞ্জ বিদ্যমান। উপরের গোলকটিতে একটি ক্যাফে রয়েছে; এটি প্রতি আধা ঘণ্টায় একবার চারদিকে ঘূর্ণনে সক্ষম। ২য় টাওয়ারটিতে একটি গোলক, এটি প্রায় এক লক্ষ গ্যালন পানি সংরক্ষণ করতে সক্ষম। তৃতীয়টি গোলকবিহীন, তা অন্য দু'টি টাওয়ার আলোকিতকরণ এবং বৈদ্যুতিক ও কারিগরি সামগ্রীর স্টোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

কুয়েত টাওয়ার নির্মাণে ৫৫,০০০ এনামেলযুক্ত ইস্পাতের চাকতি ব্যবহৃত হয়েছে এবং মসজিদের মিনারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, আকাশ ও সাগরের রঙের সাথে মিল রেখে নীল, সবুজ ও ধূসরের মিশেল ৮ ধরনের রঙের ব্যবহার করা হয়। আরব দেশে ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধির পাত্রের আদলে প্রথম এ দ্বিতীয় টাওয়ার ও মহিলাদের ব্যবহৃত আই লাইনার আকৃতির তৈরি করাহয় তৃতীয় টাওয়ারটি।

স্থানীয় সিমেন্ট ব্যবহার করেই এ স্থাপত্যের সৃষ্টি। কুয়েতের মরুভূমির পাথর ও বালি ব্যবহার করা হয়েছে কুয়েত টাওয়ার তৈরিতে।

১৯৯০ সালে ইরাকী আগ্রাসী বাহিনী কুয়েত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক কুয়েত টাওয়ারটির প্রায় ৭৫ ভাগ ধ্বংস স্তুপে পরিণত করে। পরবর্তীতে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে টাওয়ারটির সংষ্কার করা হয় এবং ১৯৯২ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর কুয়েতের গর্ব ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আবরাজ আল কুয়েত বা কুয়েত টাওয়ারটির আড়ম্বরপূর্ণ উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপত্যকে ঘিরে প্রতিবছর কুয়েতের জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবসের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান, বিমান বাহিনীর মহড়া ও আকর্ষণীয় আতশবাজির আয়োজন করা হয়। কুয়েতি ও প্রবাসীদের নিকট পারস্য উপসাগরের উপকণ্ঠে অত্যন্ত আকর্ষণীয় লেকেশনে অবস্থিত এ স্থাপত্যটি প্রাণের মেলাস্থলে পরিণত হয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কুয়েত কথন,কুয়েত,কুয়েত টাওয়ার,বুরজান আল কুয়েত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close