নাজমুল হুদা খান, কুয়েতে প্রেষণে নিযুক্ত

  ৩০ এপ্রিল, ২০২৩

কুয়েত কথন : ৯ম পর্ব

বিটুমিনাস থেকে তেলের সাগর

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন- `ভষ্ম' বাংলা কবিতার ও বাক্যটি যেন কুয়েতের বেলাতেও সত্যি। উনিশ শতকের শুরুর দিকে যখন পাশ্ববর্তী সৌদি আরব কিংবা বাহরাইনে একের পর এক তেলক্ষেত্র হাতের মুঠোয় সমাগত হচ্ছিল তখন গায়ে লাগানো ছোট্ট কুয়েত মুক্তো আহরণ ও সামুদ্রিক বাণিজ্য ছাড়া আর কোন আয় রোজগারের পথ উম্মুক্ত হয়নি। বরং মুক্তো কুড়ানো ব্যবসার প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়ায় চোখে সর্ষে ফুল দেখা ছাড়া উপায় ছিলনা।

এত কিছুর পরও হাল ছাড়তে নারাজ অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা বলে খ্যাত এবং দেশের জন্য সাহসী যোদ্ধা তখনকার আমির শেখ আহমেদ আল জাবের আল সাবাহ। এ সময় গুরুত্ত্ববহ বিটুমিনাস পদার্থ দেখতে পাওয়া যেত কুয়েতের মরুভূমির বিভিন্ন স্থানে। তখনও অনেকের ধারণা ছিলনা যে এ বিটুমিনাস পদার্থ কতটা অর্থবহ। এ সময় বাহরাইন, ইরাক ও সৌদি আরবে এংলো- পার্সিয়ান তেল কেম্পানি তেল সম্পদ সন্ধানে সাফল্য পায়। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কুয়েতে প্রাথমিক জরিপে কুয়েতের মরুভূমিতে এ বিটুমিনাস পদার্থ দেখা পেতেই আঁচ করেন যে, এখানে তেলের মজুদ থাকার সম্ভবনা আছে। বাহরাইনে ১৯৩২ সালে তেলের অনুসন্ধানে সাফল্য লাভের পর এ ধারণা আরও শক্ত ভিত পায়।

প্রাথমিক জরিপের উপর ভিত্তি করে এংলো- পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানির কক্স এন্ড রোয়েডস এর কারিগরি রিপোর্টে কুয়েতের বুরগান এলাকায় তেল অনুসন্ধানের পরামর্শ দেয়। সে পরামর্শ মোতাবেক ভৌগোলিক সার্ভের পর ১৯৩৭ সালে বুরগান এলাকায় খনন প্রক্রিয়ায় খনিজ তেল অনুসন্ধান শুরু হয়। অবশেষে সোনার হরিণ ধরা দেয়। ১৯৩৮ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি বুরগান এলাকায় তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। খননের সময় ড্রিলিং পাইপে তেলের প্রবাহের এতটা চাপ ছিল যে, তা নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল দু:সাধ্য। ড্রিলিং করা গর্ত বন্ধে পর্যাপ্ত মাটির অভাবে এংলো- পার্সিয়ান অয়েল কেম্পানির কর্মকর্তা মি. ক্যাম্পবেল শহর থেকে ৬০ ফুট লম্বা কাঠের লগ এনে তেলের অত্যাধিক চাপে উদগিরণকৃত তেলের প্রবাহ সাময়িক বন্ধের উদ্যোগ নেন। এভাবেই ১৯৩৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি বৃষ্টিস্নাত এক বৃহস্পতিবার সকাল ১১ ঘটিকায় কুয়েতের ইতিহাসে প্রথম তেলক্ষেত্র বুরগান-১ বাস্তবতায় রূপ নেয়।

ঠিক এক দশকেরও কম সময় পর ১৯৪৬ সালের ৩০শে জুন তখনকার আমীর শেখ আহমেদ আল জাবের আল সাবাহর হাতেই তৎকালীন বৃটিশ ট্যাংকার ‘বৃটিশ ফুসিলার’ জাহাজের মাধ্যমে তেল রপ্তানি শুরু হয়। সেদিন মাত্র ১ ঘণ্টা ১৩ মিনিটে ১০ হাজার ৫৬৭ টন শোধনযোগ্য তেল বোঝাই করা হয়।

আজ কুয়েত মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ হয়েও পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম তেল সংরক্ষণকারী দেশ, পরিমাণে ১০০ বিলিয়ন ব্যারেলেরও ঊর্ধ্বে, যা কুয়েত নিজ দেশে ব্যবহার করতে পারবে আরও প্রায় ৭৭৫ বছর। রাষ্ট্রের ৯০ শতাংশেরও বেশি আয় আসে তেল রপ্তানি খাত থেকে; বাৎসরিক রাজস্ব আয় প্রায় ১৫ বিলিয়ন কুয়েতি দিনার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৫২৫০ বিলিয়ন টাকারও উপরে।

কুয়েতে বর্তমানে গভীর ও অগভীর মিলিয়ে ছোট বড় প্রায় ৯৫০ টি কার্যকরী তেল কূপ থেকে তেল উত্তোলন হচ্ছে। অগভীর তেল কূপ প্রায় ৮০০টি। এগুলোর গভীরতা প্রায় ৪০০ থেকে ৭০০০ ফুট পর্যন্ত; চাপ প্রায় ৭০০০ পিএসআই। অগভীর কূপগুলো থেকে উত্তোলন হয় মোট উত্তোলনের অর্ধেক, দৈনিক প্রায় ১ মিলিয়ন ব্যারেল। গভীর কূপ রয়েছে ১৫০টি, যাদের গভীরতা প্রায় ১২০০০ থেকে ১৪০০০ ফুট পর্যন্ত, চাপ প্রায় ১৫০০০ পিএসআই। অগভীর ৮০০ কূপের সমপরিমান দৈনিক ১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে ১৫০টি গভীর কূপের।

পুরো কুয়েতের তেল ক্ষেত্রগুলোকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা : উত্তর কুয়েত, পশ্চিম কুয়েত, দক্ষিণ- পূর্ব কুয়েত এবং ওয়াফরা অঞ্চল। প্রথম তিনটি তেলক্ষেত্র কুয়েত এককভাবে নিয়ন্ত্রন ও তেল উত্তোলন করে থাকে, তবে ওয়াফরা অঞ্চল সৌদি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বিধায় সৌদি আরবের সাথে যৌথভাবে সম অধিকার ভিত্তিতে তেল উত্তোলন ও ব্যবস্স্থাপনা শেয়ার করে থাকে।

উত্তরাঞ্চলের প্রধান তেলক্ষেত্র হচ্ছে রাওধাতিয়ান ও সাবরিয়াহ। গভীর অগভীর মিলিয়ে প্রায় ৩১৬টি কূপ রয়েছে এ অঞ্চলে; তেল উত্তোলন ক্ষমতা দৈনিক প্রায় ৪ লক্ষ ব্যারেল। পশ্চিমাঞ্চলে মিনাগিস ও উম গুদেইর হচ্ছে অন্যতম প্রধান দু'টি তেলক্ষেত্র। ছোট বড় মোট ১৩০টি কূপ রয়েছে এ অঞ্চলে; তেল উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক প্রায় দেড় লক্ষ ব্যারেল। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুয়েতের প্রধান প্রধান তেল ক্ষেত্রসমূহের অবস্থান। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বুরগান তেলক্ষেত্রটির অবস্থান এ অঞ্চলে। ছোটবড় প্রায় ৬৬১টি কূপ রয়েছে এখানে। তেল উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১ মিলিয়ন ব্যারেলেরও বেশি। ওয়াফরা অঞ্চলে কূপের সংখ্যা প্রায় ৯০০টি, তেল উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক প্রায় পৌনে দুই লক্ষ ব্যারেল যা সৌদি আরবের সাথে সমবণ্টন চুক্তিতে ব্যবস্থাপনা প্রচলিত রয়েছে।

এসব তেলক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা, তেল উত্তোলন, পরিশোধন ও রপ্তানির যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে কুয়েত তেল কোম্পানি (কেওসি), কুয়েত পেট্রোলিয়াম কর্রপোরেশন (কেসিসি) এবং সহযোগী সংস্থাসমূহ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কুয়েত,তেল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close