লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, কুয়েতে প্রেষণে নিযুক্ত

  ১৫ এপ্রিল, ২০২৩

কুয়েত কথন : ৮ম পর্ব

যাদের নেতৃত্বের সিড়ি বেয়ে আজকের কুয়েত

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

পারস্য উপসাগরের উত্তর-পশ্চিম মোহনায় অবস্থিত মাত্র ৬৮৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশ হলেও তেল উৎপাদন, রিজার্ভ, এ গ্রহের অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রা এবং ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকের কুয়েত স্বমহিমায় আবির্ভূত। আরব দেশের সকল বৈশিষ্টমণ্ডিত কুয়েতে নিজস্ব নাগরিকের চাইতে প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় দেড়গুন বেশি হলেও অত্যন্ত দক্ষ নেতৃত্ত্বের মাধ্যমে নিজস্ব বৈশিষ্ট, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে সমুজ্জ্বল এ দেশটি।

রাজতান্ত্রিক এ দেশটিতে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অদ্যাবধি ১৬ জন আমিরের নেতৃত্বে পথ চলেছে। বর্তমান আমিরের অভিভাকত্বে ২০৩৫ সালের মধ্যে নিউ কুয়েত লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

এর পূর্বে দশম শতকে বুয়িদ, একাদশ শতকে তুর্কি সেলজুক, চতূর্দশ শতকে মংগোলিজ এবং সপ্তদশ শতকে তুর্কি অটোমানদের শাসনাধীন ছিল এ অঞ্চলটি। ১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কি অটোমানদের কাছ থেকে বনি খালিদ গোত্র এ অঞ্চলটি দখল করে নেয় এবং এখানে Al Kuwayit বা Little Fort নামে একটি দূর্গ গড়ে তোলে যা থেকে পরবর্তিতে বর্তমান কুয়েতের নামকরণ। এ সময় বনি উতুব নামের একটি সম্প্রদায় জীবিকার অন্বেষণে এ অঞ্চলে আগমন করে এবং বনি খালিদের আশ্রয়ে অবস্থান নেয়। বলি খালিদ তাদেরকে শর্তসাপেক্ষে এ এলাকার শাসনভার প্রদান করেন। সে মোতাবেক বনি উতুব গোত্রের সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী পরিবারসমূহ সম্মিলিতভাবে আল সাবাহ গোত্রকে ঐ অঞ্চল শাসনের সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তে নেয়। সে প্রেক্ষিতে আল সাবাহ গোত্রের প্রধান শেখ সাবাহ (১) বিন জাবের শাসনভার গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য যে, আরব সংস্কৃতি অনুয়ায়ী গোত্র প্রধানগণকে শেখ পদবীতে সম্মানিত করার প্রচলন রয়েছে। এ ছাড়া ধর্মীয় নেতা, সর্বজনীন মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তিগনকেও এ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

শেখ সাবাহ (১) ১৭৫২ সাল থেকে ১৭৬২ সাল পর্যন্ত ১০ বছর আমিরের দায়িত্ত্ব পালন করেন। তার আমলে কুয়েত বনি খালিদের ছায়ায় অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব বলয়ে শাসন কার্য্য পরিচালিত হত বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।

শেখ সাবাহ (১) এর মৃত্যূর পর দ্বিতীয় আমির হিসেবে দায়িত্ত্বভার গ্রহণ করেন শেখ সাবাহ (১) এর কনিষ্ট পুত্র শেখ আবদুল্লাহ (১) বিন সাবাহ আল সাবাহ। তিনি ক্ষমতায় থাকেন ১০ই জানুয়ারি ১৭৬২ থেকে ৩রা মে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময়। তার আমলে ওহাবী সম্প্রদায় এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকারী বনি খালিদকে পরাস্ত করে এবং শেখ আবদুল্লাহ (১) কে অটোমান সাম্রাজ্যের বস্যতা স্বীকারে বাধ্য করে। তবে ১৭৭৫ সালে তিনি কুয়েতের বাণিজ্য ও নিরাপত্তা প্রশ্নে ব্রিটিশ শাসকদের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হন।

কুয়েতের তৃতীয় আমীর হিসেবে দায়িত্ত্ব পান শেখ আবদুল্লাহ (১) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ জাবের (১) আল আবদুল্লাহ আল সাবাহ। পিতার মৃত্যূর পর তিনি ১৮১৪ সালের ৩রা মে থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছর আমৃত্যূ রাজ্যভার পরিচালনা করেন।

শেখ জাবের (১) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখা সাবাহ (২) আল জাবের আল সাবাহ ছিলেন আমিরের তালিকায় চতূর্থ। তিনি ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত বছর আমৃত্যূ দেশ শাসন করেন। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ আবদুল্লাহ (২) আল সাবাহ আল জাবের আল সাবাহ ১৮৬৬ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত ২৬ বছর ৫ম আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের চতুর্থ আমির শেখ সাবাহ (২) ২য় পুত্র শেখ মোহাম্মদ (১) আল সাবাহ আল সাবাহ ছিলেন কুয়েতের ৬ষ্ঠ আমির। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৮৯২-১৮৯৬ অবধি ৪ বছর। তারা সকলেই ব্রিটিশদের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি এবং তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে সমন্বয় সাধন করে দেশ পরিচালনা করেন।

এরপর ৭ম আমির হিসেবে ক্ষমতায় অরোহণ করেন চতুর্থ আমির শেখ সাবাহর (২) আরেক পুত্র শেখ মুবারক (১) আল সাবাহ। ১৮৯৬ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত মোট ১৯ বছর রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি মুবারক দ্যা গ্রেট হিসেবে খ্যাত। তিনি কুয়েতের স্বাধিকারের প্রশ্নে অটোমান সাম্রাজ্যের বশ্যতা ছিন্ন করে ব্রিটিশ নিরাপত্তা ও অভিভাবকত্বে দেশ পরিচালনা করেন যা ১৯৬১ সালে দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়ে এ সময়ে রাজ পরিবারে সংঘাত ও হতাহতের ঘটনাও ঘটে।

দেশটির ৮ম ও ৯ম আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৭ম আমির শেখ মুবারক (১) এর জ্যেষ্ঠ ও ২য় পুত্র যথাক্রমে শেখ জাবের (২) ও শেখ সালিম (১) শেখ জাবের (২) ১৯১৫-১৭ পর্যন্ত দুই বছর এবং শেখ সালিম (১) ১৯১৭-১৯২১ সাল প্রযন্ত ৪ বছর দেশ পরিচালনা করেন।

পরবর্তীতে রাজ পরিবারে সিদ্ধান্ত নেন যে, এখন থেকে শেখ জাবের ও শেখ সালিম পরিবার থেকে পর্যায়ক্রমে আমির হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। সে মোতাবেক ৮ম আমির শেখ জাবের (২) পুত্র শেখ আহমেদ (১) আল জাবের আল সাবাহ ১০ম আমির হিসেবে ১৯২১-১৯৫০ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর এবং নবম আমির শেখ সালিম (১) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ আবদুল্লাহ (৩) আল সালিম আল সাবাহ ১১তম আমির হিসেবে ১৯৫০- ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১৫ বছর দেশ শাসন করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৬১ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে কুয়েত স্বাধীনতা লাভ করে।

এরপর নবম আমির শেখ সালিম (১) আল মুবারকের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ সাবাহ (৩) আল সালিম ১৯৬৫-৭৭, এই ১৫ বছর ১২৩ম আমির হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন। দেশের স্বাধীনতার পর তৃতীয় এবং কুয়েতের ১৩তম আমির হিসেবে দায়িত্ত্ব পান দেশের দশম আমির শেখ আহমেদ (১) আল জাবেরের তৃতীয় পুত্র শেখ জাবের (৩) আল আহমেদ আল সাবাহ। স্বাধীনতার পর তিনিই দীর্ঘ ৩০ বছর দেশের নেতৃত্বে (১৯৭৭-২০০৬) থাকেন; তার সময় কুয়েত ইরাকী আগ্রাসনের স্বীকার হন এবং দীর্ঘ সাত মাস ( আগস্ট ১৯৯০- ফেব্রুয়ারি ১৯৯১) যুদ্ধের পর কুয়েত হানাদার মুক্ত হয়। তাকে আধুনিক কুয়েতের প্রবক্তা বলা হয়ে থাকে।

কুয়েত আমিরাতের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ১০ দিন (১৫ জানুয়ারি ২০০৬- ২৪ জানুয়ারি ২০০৬) ১৪তম আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ আবদুল্লাহ (৩) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ সাদ আল আবদুল্লাহ আল সালিম আল সাবাহ। তিনি যুবরাজ হিসেবে ইরাকী আগ্রাসন রুখতে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৫তম আমিরের দায়িত্ব পালন করেন শেখ আহমেদ (১) আল জাবেরের ৪র্থ পুত্র শেখ সাবাহ (৪) আল আহমেদ আল জাবের আল সাবাহ। তিনি ২০০৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন।

তার মৃত্যুর পর তারই ৬ষ্ঠ ভাই শেখ নওয়াফ আল আহমেদ আল জাবের আল সাবাহ ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে দেশের ১৬ তম আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি ভিশন ২০৩৫ এর মধ্যে কুয়েতকে ঢেলে সাজাতে সাত দফা লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করেছেন। কার্য্যকরী ও সেবামুখী প্রশাসন, টেকসই ও বিজ্ঞান নির্ভর অর্থনীতি, শক্তিশালী নাগরিক বান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, উচ্চমান সম্পন্ন স্বাস্থসেবা নিশ্চিতকরণ, জীবনমুখী পরিবেশ, যুগপোযোগী ও উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যাবস্থা এবং কুটনীতি, বাণিজ্য ও সংস্কৃতিতে কুয়েতকে বিশ্বমানে পৌঁছানো প্রভৃতি বাস্তবায়নে কুয়েতকে সমৃদ্ধির পথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কুয়েত কথন,কুয়েত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close