লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, কুয়েতে প্রেষণে নিযুক্ত

  ০৪ এপ্রিল, ২০২৩

কুয়েত কথন : ৭ম পর্ব

মরু, উট ও খেজুর গাছ : আরবদের তিন নায়ক  

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

তেল সম্পদ প্রাচুর্য্যে আজকের আরবদের জীবেনযাত্রার বহুবিধ পরিবর্তন সাধিত হলেও তাদের জীবনধারায় ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে মরু আবাসভূমি, খাদ্যের যোগানদার খেজুর গাছ ও নিত্যদিনের বাহন মরুর জাহাজ বা উট। প্রকৃতপক্ষে এ তিন উপাদানকে ঘিরেই প্রবাহিত হতো তাদের জীবন।

পৃথিবীর মানচিত্রে অন্যতম বৃহৎ উপদ্বীপ আরবের আয়তন প্রায় দেড় মিলিয়ন বর্গমাইল। গোবি ও পারস্য মরুভূমির মধ্যকার সাহারার কিছু অংশ ও এশিয়ার মরুতট মিলেই আরবের অবয়ব। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আটলান্টিকের জলরাশি বিধৌত ও বৃষ্টিস্নাত এ অঞ্চলে বিস্তৃণ তৃণ ভূমি ছিল বলে জানা যায়। প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো আরবের বালুরাশিতে, তার প্রমাণ মিলে এতদঞ্চলের গভীর ও শুকনো খাতগুলো থেকে।

আরবের মরুভূমিগুলো মূলত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রথমত, বিশাল অংশে রয়েছে সাদা ও লালচে বালিযুক্ত মরুভূমি। আরবের মধ্যভাগের সুবিশাল নুফুদের পুরোটা জুড়েই এ অঞ্চল । শীতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে এখানে চারণ ভূমির সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, লাল বালিতে গঠিত লাল ভূমি উত্তরে আল নুফুদ থেকে দক্ষিণে আল রাব আল খালি ( ছবিতে) পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে মৌসুমী বৃষ্টিপাত হলেও গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমে জনহীন প্রান্তরে পরিণত হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে বেলেপাথর যুক্ত মরুভূমি, যা মূলত অগ্নুৎপাত থেকে সৃষ্টি। এটির অবস্থান উত্তর থেকে পূর্ব হাওরান পর্যন্ত। ঐতিহাসিকদের মতে এখানে ১২৫৬ সালে শেষ অগ্নুৎপাত ঘটেছিল।

মরুভূমি শুধু আবাসভূমি নয়, এর সাথে মিশে আছে আরবদের ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা ও নিরাপত্তাসহ জীবনের অনেক কিছু। যুগে যুগে এ মরুভূমি বহি:শত্রুর আগ্রাসন ও আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়। স্বাভাবিক সময়ে পানির অভাব, তাপদাহ, দিশাহীনতা কিংবা খাবারের অপ্রাচুর্য থাকলেও বিপন্ন অবস্থায় বিশ্বস্থ বন্ধু হয়েছে বারংবার। মরুভূমির কারণেই বহি:শত্রুর কাছে আরবরা খুব কমই মাথা নত করেছে।

আরবদের আরেক উঠোন সঙ্গী উট। মানব সভ্যতায় প্রাণী হিসেবে ঘোড়া যদি বিজয় অভিযানের অগ্রগতির বাহন বলা হয়, তাহলে উট একই ভাবে আরবদের জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সাথী বলা চলে। ইতিহাস বলে, এক সময় উট ছাড়া মরুভূমিতে চলাচল ছিল কল্পনাতীত। মরুভূমিতে পানীয় জলের অভাব পূরণ করত উটের দুধ, এর মাংস উপাদেয় খাদ্যের অন্যতম, চামড়া ব্যবহৃত হত পোশাক তৈরিতে, পশম দিয়ে হত তাবু, মল ব্যবহৃত হয় জ্বালানি হিসেবে, এমনকি উটের মূত্রেও চুলের টনিক ও ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খোলাফায়ে আমলে যেসব অঞ্চলে উটশিল্পের উন্নতি ঘটেছে, সেখানেই আরবদের সমৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। এক সময় পারস্য উপসীগরীয় অঞ্চলে উটশিল্প ছিল আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। মরুভূমির জাহাজ হিসেবে খ্যাত এ উটকে আল্লাহর উপহার হিসেবেও পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব ১১ শতকে ফিলিস্তিন ও সিরিয়া যুদ্ধে, খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম শতকে আসিরিয় যুদ্ধে এবং ৭০০ সালে উত্তর আফ্রিকা যুদ্ধে ব্যাপকভাবে উট ব্যবহারের প্রচলন ছিল।

আরব দেশের উদ্ভিদ রাজ্যে খেজুর গাছকে বলা হয় রানি। অত্যন্ত শুষ্ক আবহাওয়া, তাপদাহ ও মাটির লবণাক্ততার জন্য ফুল বা ফলবতি বৃক্ষের সমাহার নেই বললেই চলে। খেজুর গাছের জন্য মরুভূমির আবহাওয়া বেশ সহিষ্ণু। তবে আরব উদ্ভিদগুলোর এ রানির আগমন কিন্তু মেসোপটেমিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে। বলা হয় এক সময় উটের মাংস ও দুধ ছাড়া খেজুরই ছিল আরবদের অন্যতম খাবার। শুধুমাত্র সৌদি আরবেই প্রায় ১০০ ধরনের খেজুর পাওয়া যায়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কতক দেশেই বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন টন উৎপাদন হয়। এখনও আরব দেশসমূহের মানুষের নিকট খেজুর অত্যন্ত উপাদেয় ও প্রিয় খাবারের অন্যতম। অফিস, আদালত, দেওয়ানিয়াসহ সর্বত্র খেজুর দিয়ে আপ্যায়ন করা যেন তাদের রীতি। হাজার বছর পরও এর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি।

তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ আরব দেশসমূহের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, যানবাহন, রাস্তাঘাট, জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রযাত্রাসহ বহুবিধ বিষয়ে আধুনিকতা ও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে; টেকসইকরণ হয়েছে সর্বক্ষেত্রে তাদের জীবনপ্রবাহের উন্নয়ন। তথাপি বিশ্ববাসীর কাছে আরব মানেই মরুভূমির দেশ; উট আর খেজুর গাছ মানেই আরব দেশসমূহের প্রতীক হিসেবেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে। আরবরাও বংশ পরম্পরায় তাদের জীবন বাঁচাতে ও জীবনকে প্রবাহমান রাখতে মরু, উট আর খেজুর গাছকে ভুলেনি। মরুভূমির পরিবেশ রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর, উটশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নিচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ, বাড়ছে খেজুরের বাণিজ্যিকিকরণ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরব,কুয়েত কথন,খেজুর,উট,মরুভূমি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close