লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান
কুয়েতে প্রেষণে নিযুক্ত
কুয়েত কথন ষষ্ঠ পর্ব
দেওয়ানিয়া বা বৈঠক ঘর-কুয়েতিদের প্রাণের স্পন্দন
আরবদের জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন সূত্রের সংশয় থাকলেও ধারণা করা হয়, মোটামুটি খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগে সেমেটিয় ও হ্যামেটিয় জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে কালক্রমে আরবদের উদ্ভব।
শব্দের বুৎপত্তি অনুয়ায়ী আরব শব্দটি সেমিটিক অর্থাৎ পরিত্যক্ত অথবা এমন এক জনগোষ্ঠী যাদের জাতীয়তার উৎস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মরু অঞ্চলের জমির দ্বিমুখী রূপের কারণে আরবরা যাযাবর বেদুইন ও স্থায়ী বাসিন্দা এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। বেদুইনরা মরুর কঠিন জীবনে অভ্যস্থ ছিল; আর অপেক্ষাকৃত ফসলের চাষবাস হয়, নদী বা সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে স্থায়ী বসতি ছিল অনেকের। তবে সময়ের পরিক্রমায় সকলেই এখন স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হয়েছে, ক্রমিক রূপান্তর বদলেছে তাদের জীবন চরিতও।
বর্তমান আরবের নাগরিকরা আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হলেও তাদের পূর্ব পুরুষদের মরুর কঠিন জীবনে খাপ খাইতে নিতে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের সে ধারা এখনও তাদের দৈনন্দিন জীবনধারণে ফুটে উঠে। বহুবিধ সে সংস্কৃতির অন্যতম - আরবদের আড্ডা প্রিয়তা। পরিবার, নিকটজন, বন্ধু, সহকর্মীসহ সকলকে অভ্যর্থনা, কুশল বিনিময়, ভাবের আদান প্রদান; ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল বিষয়ে আলাপচারিতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্মিলিতভাবেই তারা নিয়ে থাকে।
কুয়েতের সব শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে এ সংস্কৃতি চলে আসছে আবহমানকাল থেকেই। বাড়ির আঙ্গিনায়, অফিস কমপ্লেক্সের বাইরে সুবিধামতো স্থানে, এমনকি অফিসের মধ্যেও ছোট্ট পরিসরে এ কার্যক্রমের জন্য আলাদা স্থাপনা তৈরি করা হয়; যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় দেওয়ানিয়া, আমাদের ভাষায় বৈঠক ঘর।
দেওয়ানিয়া শব্দটি এসেছে পার্সিয়ান শব্দ দিভান হতে, যার বুৎপত্তি সুমেরিয়ান অঞ্চলের ব্যবহৃত dub বা কাঁদা দিয়ে তৈরি এক ধরনের টেবিল থেকে। প্রকৃতপক্ষে কুয়েতে দেওয়ানিয়া হচ্ছে এক ধরনের বৈঠক ঘর; যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কার্যসাধনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুয়েতের ২৫০ বছরের ইতিহাসে ব্যক্তিগত, সামাজিক যোগাযোগ সমন্বয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দেওয়ানিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দু'ধরনের দেওয়ানিয়ার প্রচলন রয়েছে কুয়েতে। সামাজিক, প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক দেওয়ানিয়াসমূহ আনুষ্ঠানিক; ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দেওয়ানিয়াসনূহকে অনানুষ্ঠানিক হিসেবে গণ্য করা করা হয়। এর বাইরে কোন কোন বিশেষ শ্রেণি-পেশার মানুষ, তরুণ সমাজ, সমিতি ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ সময় বা উদ্দেশ্যে অস্থায়ী দেওয়ানিয়া গড়ে তোলে, যেমন: জাতীয় দিবস বা হালা ফেব্রুয়ারি উদযাপন, একসাথে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত ,পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে গড়ে উঠা দেওয়ানিয়া কুয়েতের মানুষের শেকড় ও ঐতিহ্যের অংশ। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দেওয়ানিয়া উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক বিকাশের পরিক্রমায় ভিন্ন আদলে আধুনিক অবয়বে গড়ে উঠে।
ব্যক্তিগত ,পারিবারিক ও সামাজিক সীমানায় গড়ে উঠা দেওয়ানিয়ায় দৈনন্দিন আড্ডা, অভ্যর্থনা, কুশল বিনিময়, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, ছোটখাট বিষয়ে সংঘাত, মতবিরোধের মিমাংসা, অনুষ্ঠানাদি আয়োজন, বিভিন্ন উৎসব উদযাপন, কমিউনিটি বা সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে ফয়সালা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি কার্য্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া সামাজিক কাঠামোতে প্রায়শ:ই তরুণ জনগোষ্ঠী বা বিভিন্ন ক্লাব বা সংস্থার উদ্যোগে অস্থায়ী দেওয়ানিয়াও স্থাপন করতে দেখা যায়। এসব দেওয়ানিয়া নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড শেষে বন্ধ করে দেয়া হয়।