মাসুদুল হক

  ১১ অক্টোবর, ২০২২

করোনা পরবর্তী প্রাথমিক শিক্ষার গতিপথ : সম্ভাব্য উত্তরণের উপায়

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

কোভিড-১৯ মহামারি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা এই ভাইরাসের কারণে কিছুটা ব্যাহত। বিশ্বব্যাপী এই মহামারি আমাদের প্রতিদিনের কাজ, আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, আমাদের শিক্ষা, সামাজিক কার্যকলাপকে আমূল বদলে দিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বিশ্বকে আরো কতটা সময় দিতে হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত ৬২ কোটি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয় যার মধ্যে প্রায় ৬৫ লাখ ৫০ হাজার আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যান। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ২০ লাখ ৩০ হাজার করোনা আক্রান্তের বিপরীতে মারা যায় ২৯ হাজার ৩৭৬ জন।

চীন থেকে ছড়িয়ে ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে, দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ১৬ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও অনলাইনের মাধ্যমে অধিকাংশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে সরাসরি পাঠদান পুনরায় চালু না হওয়া পর্যন্ত। করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির ফলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পিএসসি, জেএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশন দেওয়া হয়। যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা নিশ্চিতের পথে উদ্বেগ জাগায়। এরই মাঝে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে না আসায় পরের বছর ২০২১ সালে অটোপ্রমোশন না হলেও সম্পূর্ণ বছর পাঠদান সম্ভব না হওয়ায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের আলোকে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর প্রকাশিত ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো এশিয়ায় শিক্ষা খাতের ওপর ‘কোভিড-১৯-এর প্রভাব ও মোকাবিলা কার্যক্রমবিষয়ক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ (সিটএন রিপোর্ট) শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর এবং দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়াসহ এশিয়ার প্রায় ৮০ কোটি শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে।

সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও কয়েক দফা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে চালুর চেষ্টা কয়েকবার বিফলে যায়। অনলাইন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন হয়নি। পরবর্তী সময়ে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়। ফলে একদিকে শিশু শিক্ষার্থীরা পরিবর্তনশীল পরীক্ষামূলক আকস্মিক ব্যবস্থাপনায় মানিয়ে চলতে হিমশিম খায় অন্যদিকে পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ না থাকায় পরীক্ষিত পদ্ধতি ব্যবহারের বিকল্প পথের সংখ্যাও হ্রাস পায়।

স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় শিশু শিক্ষার্থীদের তখনো টিকার আওতায় আনা সম্ভবপর হয়নি। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনোদৈহিক যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সেটিও বড় আকারে দানা বাঁধতে শুরু করে। সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে সপ্তাহে দুদিন করে বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু করা হয়।

করোনাকালে শিক্ষার্থীরা বাইরের পৃথিবী থেকে দূরে থাকায় অতিরিক্ত মোবাইলমুখী হওয়ার মতো বড় সমস্যা তৈরি হয়। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে করোনাকাল উত্তরণ পরবর্তী সময়েও শিশু শিক্ষার্থীদের মোবাইলমুখী হওয়ার প্রবণতা রয়ে গেছে। এই অভ্যাস থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের হঠাৎ করে সরিয়ে আনা যাবে না। বরং ক্রমান্বয়ে মোবাইল স্ক্রিন টাইমের দৈর্ঘ্য কার্যকর পরিমাণে কমিয়ে আনার জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে শিশুর অভিভাবককে।

অভিভাবকদের তদারকির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এই অভ্যাসকে পুঁজি করে শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবা যেতে পারে। এখনই মোবাইলে কার্টুন দেখা বা গেম খেলার মতো নেশাজাতীয় অভ্যাসকে ধীরে ধীরে শিক্ষা উপকরণে পরিণত করে সূক্ষ্মভাবে ক্রীড়ামোদের আনন্দে পরিণত করে শিখন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টার দূরদৃষ্টির ফলে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ প্রকল্পের আওতায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি জেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার প্ল্যাটফরম ‘স্কুল অব ফিউচার’ এরই মধ্যে চালু হয়েছে। যেখানে গ্রাফিক্সের দ্বারা ইন্টারেক্টিভ মনিটরের মাধ্যমে অনলাইন শিখনের ব্যবস্থা রয়েছে। যার বিস্তৃত রূপকে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। ফলে প্রতিটি মোবাইল ফোন একেকটি ইন্টারেক্টিভ মনিটর হিসেবে শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে বাংলা ও ইংরেজি কবিতা ও গল্প, ছড়াসহ ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে ‘গ্রাফিক নভেল’ আকারে বা অনলাইন প্ল্যাটফরমে মোবাইল এপ্লিকেশনে রাখা গেলে শিশু শিক্ষার্থীদের স্ক্রিন টাইমকে কাজে লাগানো সম্ভব। ফলে শিক্ষার্থীরা খেলাচ্ছলে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অধ্যয়নের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে।

এছাড়াও দুই বছর করোনাকালে সংক্রমণ রোধকল্পে সামাজিক দূরত্বের বিধির বাধ্যবাধকতায় শিশু শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে করোনা পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে শিশুদের সময় লাগছে। দূর সম্পর্কের আত্মীয় বা অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা সামাজিকভাবে মিশতে পারছে না বা অস্বন্তি অনুভব করছে। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একটি নির্দিষ্ট পাঠদানের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে যেখানে পরস্পরের সঙ্গে আন্তরিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পায়।

সেজন্য শ্রেণিকক্ষে শিশুতোষ আনন্দদায়ক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন রাখা যেতে পারে। শিশুরা দুই বছর স্কুলমুখী না হওয়ায় তাদের মাঝে যে জড়তা তৈরি হয়েছে সেটি কাটানোর জন্য উৎকৃষ্ট ও একমাত্র উপায় স্কুলগুলোতে শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য বন্ধুসুলভ আচরণ নিশ্চিত করা।

শিক্ষক, প্রয়োজনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ইমাম ও গণ্যমান্যদের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিটি ক্যাচমেন্ট এলাকায় করোনাকালে পিছিয়ে ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের একটা তালিকা তৈরি করে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করে প্রয়োজনের নিরিখে তাদের মনো-দৈহিক বিকাশে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক সহায়তা প্রয়োজন। তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও অভাবগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় বই, খাতা-কলম এবং বিশেষ করোনাকালীন বৃত্তি দিয়ে হলেও স্কুলগমন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

সর্বোপরি শিশুদের প্রাণবন্ত ও আনন্দমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ, পরীক্ষা ভীতি না দেখিয়ে বরং শিশুবান্ধব খেলার সামগ্রী পর্যাপ্ত সরবরাহের মাধ্যমে শিশুদের স্কুলগামী করাই করোনা পরবর্তী প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রণী সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সেই ধারাবাহিকতায় সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। যেমনÑ বছরের শুরুর দিনই রঙিন বই তুলে দেওয়া, ঝরে পড়া রোধে উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আনন্দ স্কুল এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম, সিøপ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয়কে শিশুবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা, প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি-৪-এর মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন, নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করে শিশুদের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, ই-মনিটরিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন, শিক্ষকদের দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ, শিশুদের জন্য নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক মনোভাব গড়ে তুলতে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি শিশুদের সেবামূলক মনোভাব গড়ে তুলতে ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে বিসিএস নন ক্যাডার থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের নতুন পদ সৃষ্টিসহ শূন্য পদ পূরণ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম-প্রহরী নিয়োগ, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু, পিটিআইগুলোতে আইসিটি ল্যাব স্থাপন করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্ট সরবরাহের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রায় শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি, শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সমতা আনয়ন, নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন পাঠ্যবই, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু, অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে যা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি আলোকিত জাতি গঠনের মাধ্যমে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা এবং সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পঞ্চগড় সদর, পঞ্চগড়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোভিড,শিক্ষা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close