কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ১৬ জুলাই, ২০২২

বাড়ছে সাগর ও নদীর পানির উচ্চতা, শঙ্কা বিপদের

ফাইল ছবি

বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা বাড়ছে ভয়াবহভাবে। ফলে বাড়ছে বিপদ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশেও অস্বাভাবিকভাবে পড়তে শুরু করেছে। সমুদ্রের পানি প্রতি বছর বাড়ছে শূন্য দশমিক ১৪ ইঞ্চি হারে। দিন যতই যাচ্ছে পানির উচ্চতা বাড়ছে। গত ৩০ বছরে উচ্চতা বেড়েছে প্রায় ৬ ফুটেরও বেশি। বর্তমানে পানির ঢেউ উপচে পড়ছে পাড়ে। মাঝে মাঝে সমুদ্রের পানি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি বেড়ে যায়। অনেক সময় ৮ ফুট উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র পাড়ের দোকান-পাট। পূর্নিমার কারণে জোয়ারের পানি এত প্রবলভাবে বেড়ে যায় যে, চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে কোমর সমান পানি উঠে যায়। বিশেষ করে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ, হালিশহর, খাতুনগঞ্জসহ পশ্চিমাংশে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়েই চলেছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে চট্টগ্রাম শহরও হুমকীর মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সমুদ্র পাড়ের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার পর এনবায়োরনমেন্টাল এন্ড জিউগ্রাফিক ইনফরমেশন’ এর তথ্য মতে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোতে বিলীন হচ্ছে প্রচুর জমি-ঘরবাড়ি। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নদীগর্ভে গেছে ১ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর ভূমি, যা দুটো সিঙ্গাপুরের সমান।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘দ্যা লুমিং থ্রেট অব সি লেভেল রাইজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে বেশ ভালোভাবেই পড়ছে। পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে ডুবে যাচ্ছে নিচু এলাকা। উপকুলীয় এলাকাগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সাগরের পারি উচ্চতার সাথে সাথে প্রধান প্রধান নদীগুলোতে পানির উচ্চতাও ক্রমশ বেড়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয়ের বরফ গলা পানির স্রোত বাংলাদেশে সরাসরি ঢুকছে। বন্যা, জলোচ্ছাস দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। সাগরে পানির উচ্চতা প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ মিলিমিটার হারে বাড়ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এটি ৯ মিলিমিটারও হচ্ছে।’

সাগরে পানির উচ্চতা বাড়ার প্রভাব পড়ছে সারা দেশে। প্রধান প্রধান নদীগুলো থেকে উপচে পড়া পানিতে সয়লাব হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। সাথে যোগ হয়েছে জোয়ারের পানি। এখন প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানির সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিনের মানুষ। জোয়ারের পানির উচ্চতা ৬ ফিট উঠার পর দ্বীপাঞ্চলের মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয়গ্রহণ করে। সম্প্রতি আবহাওয়ার বিরুপ আচরণের ফলে জোয়ারের তরঙ্গে উপকূলীয় এলাকার অনেক ঘর ভেসে যায়। উপকূলের বনভূমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সাগরে মাঝে মাঝে যে জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয় তাতে হ্যাচারি ব্যবসায়ীরাও বিপাকে রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে সাগর অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এ অস্বাভাবিক আচরণকে দ্বীপাঞ্চলের মানুষরা বরাবরের মতোন সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা বলে অবহিত করছেন। অবস্থা এখন এমন যে, ভাটার সময় পানি কিছুটা কমলেও জোয়ারের তরঙ্গ পুনরায় আঘাত করছে। চট্টগ্রামের উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষ সাগরের এ আচরণকে পূর্ণিমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বললেও কারও মতে সাগরের নিচে ভুমিকম্পজনিত ফাটলের প্রতিক্রিয়ায় এ অস্বাভাবিক আচরণ।

গত কয়েকদি;ন ধরে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ও জোয়ারের প্রবল ঢেউয়ের পানি ঢুকে পড়ে শহরে। পতেঙ্গা, হালিশহর, সরাইপাড়া, জেলেপাড়া, কাট্টলীসহ শহরের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে সমুদ্রের জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। আগ্রাবাদের অভিজাত সিডিএ এলাকার বেশিরভাগ রাস্তা হাটু পানি, অনেকাংশে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। বুধবার রাত থেকে পানি উঠতে থাকলে এলাকাবাসীর মধ্যে আতংক দেখা দেয়। বিশেষ করে সমুদ্র পাড়ের এলাকাগুলোতে পানির পরিমান পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। নগরীতে বর্ষাকালেও তেমন বৃষ্টি না হলে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার পানির অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ে অফিসগামী লোকজন। এ অবস্থা কখনও হয়নি বলে উল্লেখ করেন অনেকে। নগরীর পতেঙ্গাসহ উপকুলীয় এলাকায়ও বেড়িবাঁধের ফাকঁফোকরে আশপাশের এলাকায় ঢুকে পড়ে সাগরের উত্তাল জলরাশি।

সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে উপকুলীয় এলাকা বাশঁখালি ও আনোয়ারার অনেকাংশ পানিতে তলিয়ে যায়। এলাকাবাসী বলছে, পূর্ণিমার প্রভাব ও বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে উপকুলীয় এলাকায় ঢুকে পড়েছে সাগরের পানি। বিশেষ করে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা থানা এবং নগরীর পতেঙ্গাসহ উপকুলীয় এলাকায় ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ে সাগরের পানি। এতে এসব এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগের মুখে পড়ে। সাগরের লোনা পানি ঢুকে ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। জেলার বাঁশখালীর উপকুলবর্তী অন্তত ১৫টি গ্রামে সাগরের লোনা পানি ঢুকে পড়ে। বিশেষ করে খানখানাবাদ, কদমরসুল, প্রেমাসিয়া, কাথারিয়া, ডোংরা, সাধনপুরের অনেক গ্রামে বাধ ডিঙিয়ে সাগরের পানি ঢুকে সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকার দেড়শ থেকে ২০০ ঘরবাড়ি হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ডুবে যায় অনেক রাস্তাঘাটও। বাঁশখালীর ৩৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০ কিলোমিটারই ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। তাই সাগরে কোন চাপ সৃষ্টি কিংবা পূর্ণিমা-অমাবশ্যার সময় বেড়িবাঁধবিহীন এলাকায় সাগরের জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে।

আনোয়ারার অনেক এলাকাও অস্বাভাবিকভাবে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। রায়পুর ইউনিয়ন, গহিরা, পূর্ব গহিরা, সরেঙা, পশ্চিম রায়পুরসহ আরো কয়েকটি এলাকায় অসংখ্য ঘরবাড়িতে জোয়ারের পানি ঢুকে যায়। আভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়ে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। একইসাথে আনোয়ারার শত শত একর ফসলি জমিতে সাগরের লোনা পানি ঢুকে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ফাটল ও আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে সমুদ্রের অস্থিরতা। সমুদ্রের পানি প্রতি বছর বাড়ছে শূন্য দশমিক ১৪ ইঞ্চি হারে। দিন যতই যাবে ততই উচ্চতা বাড়বে। ফলে দেশের উপকুলীয় এলাকাগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আগামী ২০৫০ সালে সমুদ্রের পানির স্বাভাবিক উচ্চতা বাড়বে প্রায় ৪ ফুট। গত ২০১০ সালে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপাঞ্চলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প এবং ২০১১ সালের ৩ জুন নিকোবর দ্বীপাঞ্চলে ৫ দশমিক ৯ মাত্রার ভুমিকম্পের কারণে সমুদ্রের ফাটল কি অবস্থায় রয়েছে তা নিয়েও বাড়ছে নানা সংশয়।

সমুদ্রের পাড়ে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম ইপিজেড, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরসহ চট্টগ্রামের ভারী শিল্পগুলো। পানির উচ্চতা ও সমুদ্রের বিরূপ আচরণের কারণে শংকিত এসব এলাকার মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রের পানির উচ্চতার দিকে নজর না দেয়ার কারণে নীরবে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়া এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে সংশয় বাড়ছে। বিগত ৯১ সালের প্রবল ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের কারণে এসব এলাকার ৮০ শতাংশই ধবংস হয়ে যায়। পরে তা আবার গড়ে উঠে। এ অবস্থায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রনে না এলে ৯১ সালের মতো যে কোন বড় ধরনের ক্ষতি হবার আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মত ব্যক্ত করেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাগর,নদী,পানি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close