লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ১৩ জুন, ২০২২

জীবন বাঁচাতে রক্ত দিন  

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

একবার ভাবুন, মা প্রসবকালীন রক্তক্ষরণে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে; একটি শিশু রক্তশূন্যতাকে জয় করে সুস্থ জীবনের আলো হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে; একজন রোগী রক্ত বা অস্থিমজ্জার রোগের সঙ্গে লড়াই করছে; এক ব্যক্তি আজন্ম হিমোগ্লোবিন-স্বল্পতা রোগ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছে কিংবা হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। সবাই আমাদের মতো মানুষ। সবাই চিকিৎসা পেতে সমান আগ্রহী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সময় বিশেষ অপারেশনের টেবিলে এক ব্যাগ রক্তের জন্য চিকিৎসক এগোতে পারছেন না জীবন বাঁচানোর অপারেশনে। তখন অসহায় ব্যক্তিদের চাওয়া-পাওয়া একটাই- ‘এক ব্যাগ রক্ত চাই’। জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে সহজ সহযোগিতার এ হাতটি আমরা ইচ্ছে করলেই বাড়িয়ে দিতে পারি স্বেচ্ছায় এক ব্যাগ রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে। বিশ্বে সব দেশ, বর্ণ ও জাতির এসব অসহায় মানুষের পাশে সহযোগিতা ও সংহতি প্রদান করতেই- ‘Donating blood is an act of solidarity. Join the effort and save lives’- এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৪ জুন প্রতি বছরের মতো সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’।

রক্ত মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং একমাত্র পরিবহন মাধ্যম। এটি শরীরের রক্তনালি ও শিরার মাধ্যমে দেহের প্রতিটি কোষে খাবার ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমকে সচল রাখতে বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোন পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে থাকে নীরবে। দেহের বর্জ্য পদার্থকে বের করে দেওয়া, দেহের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, দেহের ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষাসহ শত মহাকর্মযজ্ঞ পালন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এ রক্ত। এ রক্ত আমাদের দেহে ২৪ ঘণ্টায় নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহিত হয় ১২ হাজার মাইল বিস্তৃত রক্তনালি ও শিরার মাধ্যমে। এ সময় প্রায় আট হাজার গ্যালন রক্ত সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে আমাদের একমাত্র হৃৎপিণ্ড। মানবদেহের এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঘাটতি দেখা দিলেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন অসুখণ্ডবিসুখ ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে রক্তের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। বড় ধরনের অপারেশন, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, নবজাতকের রক্তশূন্যতা বা রক্ত রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন ক্যানসার রোগের চিকিৎসা, অগ্নিদগ্ধ রোগীর ব্যবস্থাপনায়, রক্তস্বল্পতা রোগীর চিকিৎসা, থ্যালাসামিয়া বা হেমোফিলিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় রক্তের ব্যবহার অত্যাবশ্যক।

রক্ত এমন একটি উপাদান, যা এখনো পর্যন্ত কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা যায়নি বা অন্য কোনো প্রাণীর রক্ত মানুষের শরীরে ব্যবহার করা যায় না। একজন মানুষের দেহের রক্তই শুধু অন্য একজনের শরীরে ব্যবহার করা যায়। তবে চাইলেই একজন মানুষের রক্ত আরেকজনের শরীরে সঞ্চালন করা যাবে না। তার কারণ মানুষের রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। রক্তের লোহিত কণিকা এবং রক্তরসে রাসায়নিক উপাদানগত কিছু তারতম্য রয়েছে। রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ বিদ্যমান, তবে রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে A, B, AB, O এবং Rh ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। এসব আবিষ্কারে ভূমিকা রাখেন তিনজন বিজ্ঞানী।

১৯৬৮ সালেই ১৪ জুন জন্ম নেওয়া অষ্ট্রীয় জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার রক্তের মূল গ্রুপ ‘এ’, ‘বি’, এবং ‘ও’ আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন, একই গ্রুপ থেকে রক্ত একে অপরের দেহে সঞ্চালনে কোনো ক্ষতি নেই। এরপর তারই দুই সহযোগী আলফ্রেড ডন এবং আদ্রিয়ানো ‘এবি’ গ্রুপটি শনাক্ত করেন। পরে ১৯৪১ সালে বিজ্ঞানী ফিলিপ লেডাইন Rh ফ্যাক্টরটি আবিষ্কার করেন। যাদের দেহে এ ফ্যাক্টর বিদ্যমান তাদের রক্তকে বলা হয় Rh (+ve) এবং যাদের দেহে এ ফ্যাক্টরটি থাকে না তাদের রক্তে Rh (-ve) গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একজনের দেহ থেকে রক্ত আরেকজনের দেহে সঞ্চালনের আগে অবশ্যই গ্রুপ ম্যাচিং এবং Rh ফ্যাক্টর মিলিয়ে নিতে হবে।

মূলত রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারক ও নোবেলজয়ী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারের জন্মদিন ১৪ জুনকেই বেছে নেওয়া হয়েছে ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্দেশ্যে। তবে ১৯৯৫ সাল থেকে International Federation of Blood Donor Organization-এর উদ্যোগে এ দিবস পালন শুরু হয়। পরে ২০০৪ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং আন্তর্জাতিক রক্ত সঞ্চালন সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে প্রথমে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালন শুরু হয় এবং পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সাল থেকে সারা বিশ্বে এ দিবস পালনের নির্দেশনা ও তাগিদ প্রদান করে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বে অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও এ দিবস পালিত হয়ে আসছে।

বিশ্ব প্রতি বছর প্রায় ১০-১১ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান করা হয়, তবে এর মাত্র চল্লিশ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশ থেকে, যেখানে ৮০ শতাংশের ওপর মানুষের বসবাস। তাই এখনো বিশ্বের অনেক দেশে রক্তের প্রয়োজন হলেই নির্ভর করতে হয় পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধ কিংবা পেশাদার রক্তদাতার ওপর। বিশ্বের স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হার প্রতি হাজারে ৪৫ জন; বাংলাদেশে এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতি হাজারে মাত্র ৪ জন। বাংলাদেশে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বছরে প্রায় ১৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলেও স্বেচ্ছায় রক্তপ্রাপ্তি অর্ধেকের চেয়েও কম। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের মাত্র ৫ শতাংশ লোক বছরে মাত্র দুবার রক্ত দিলেই এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব।

১৮-৬০ বছরের যেকোনো সুস্থ ব্যক্তির ওজন যদি ৪৫ কেজির ওপর থাকে তাহলে সে প্রতি চার মাস অন্তর নিয়মিত রক্তদান করতে পারে। আমাদের দেহে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে, যা থেকে এক দশমাংশ অর্থাৎ ২৫০-৪৫০ মিলি রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি তো হয়ই না বরং নানান উপকারিতা রয়েছে এ রক্তদানের। রক্তদানের ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে, রক্তদাতার অস্থিমজ্জার কার্যকারিতা অনেক গুণে বেড়ে যায় এবং রক্তস্বল্পতা দূরীভূত হয়। রক্তদাতার রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ কমে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে। রক্ত প্রদানের ফলে অস্থিমজ্জার সক্রিয়তার কারণে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। রক্ত প্রদান করলে যে ক্যালরি খরচ হয় তাতে শরীরের ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

তবে রক্ত দেওয়ার আগে দাতার জ্বর, সর্দি-কাশি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ইত্যাদি রোগ আছে কি না নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন ও ইনসুলিনের মাধ্যমে চিকিৎসা চলমান থাকলে রক্ত প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। ছয় মাসের মধ্যে কোনো বড় অপারেশন হলে বা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রক্ত না দেওয়াই ভালো। রক্ত দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে না কিংবা আগে রক্ত দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস থাকলে রক্ত না দেওয়াই শ্রেয়। রক্তের জন্য কোনো ওষুধ খেলে বা গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অ্যালকোহল সেবন করলে রক্তদান অনুচিত। রক্তদানের আগের রাতে ভালো ঘুম দেওয়া শরীরের জন্য কল্যাণকর। রক্ত দেওয়া আগে সাধারণত আধা লিটার পানি পান করতে পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। রক্ত দেওয়ার পর মাথা ঘোরালে বা কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করলে, সুস্থেেবাধ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশও বিশ্ব রক্তদাতা দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় দক্তদান, রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা, একাধিকবার স্বেচ্ছায় রক্তদানকারীদের সৌজন্যমূলক উপহার প্রদান ও থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বিনা মূল্যে রক্ত প্রদানসহ নানা কর্মসূচি অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন অনেক জীবন বাঁচায়। তাই রক্তের চাহিদা নিরন্তর। প্রতিদিন বিশ্বে রক্তের অভাবে বহু মানুষের প্রাণ গেলেও আমাদের অনেকেরই রক্তদান সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কার ও ভুল ধারণা রয়েছে। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের কারণে মানুষের মধ্যে রক্ত প্রদানে সচেতনতা দিন দিন বাড়ছে। আসুন, মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে নিজে রক্ত দিই এবং অন্যকে রক্তদানে উৎসাহিত করি।

লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রক্ত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close