লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান
নার্সিংসেবায় সমস্যা ও সম্ভাবনা
বিশ্বের সব নার্সের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন ১২ মে। এ দিন সব নার্সের আইকন ফ্লোরেন্স নাইটিংগলের জন্মদিন। আধুনিক নার্সিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ফ্লোরেন্স নাইটিংগল একজন ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ এবং সমাজসেবক। ক্রিমিয়ান যুদ্ধে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সহমর্মী সেবার মাধ্যমে তিনি নার্সিংসেবাকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেন। যুদ্ধক্ষেত্রের অন্ধকারেও মোমবাতি হাতে আহত যোদ্ধাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সেবা দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ‘Lady with the lamp’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮২০ সালের ১২ মে জন্ম নেওয়া এ মহীয়সী নারীর জন্মদিনকেই আন্তর্জাতিক নার্স দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এবং ১৯৭৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসটি স্বীকৃতি লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। আন্তর্জাতিক নার্সিং কাউন্সিল (INC) এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে Nurses: A Voice to Lead – Invest in nursing and respect rights to secure global health. অর্থাৎ ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী নার্স নেতৃত্বের বিকল্প নেই- বিশ্ব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে, নার্সিং খাতে বিনিয়োগ বাড়ান ও নার্সদের অধিকার সংরক্ষণ করুন।’
নার্সিংসেবা যেকোনো দেশের স্বাস্থ্য খ্যাতের অন্যতম অনুষঙ্গ। গত দুবছর সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ যুদ্ধে নিজেরা আক্রান্ত হয়ে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সামনের কাতারে থেকে লড়াই চালিয়ে গেছেন নার্সরা। পাশাপাশি সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করছে দিবানিশি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত; সংক্রামক, অসংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে দীর্ঘস্থায়ী সব রোগের ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল, কমিউনিটি কিংবা অসুস্থের দোরগোড়ায় পৌঁছে যারা ক্রমাগত সেবা, শুশ্রুষা, রোগের প্রতিরোধ, প্রতিষেধক এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অবিরাম কাজ করে যায় তারা নার্স ছাড়া আর কেউ নন।
রোগীর সবচেয়ে সন্নিকটে সেবার হাত বাড়িয়ে দেন একজন নার্স। হাসপাতাল বা কোনো সেবা প্রতিষ্ঠানের সবাই নিশ্চিন্তে থাকে নার্সের হাতে সেবার দায়িত্বটি তুলে দিয়ে। দিবারাত্রি ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহের ৭ দিন কিংবা মাসের ৩০ দিন রোগীর পর্যবেক্ষণ, সেবা প্রদান, সমস্যা নিরূপণ, শ্রেণিবিন্যাস, পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন, ওষুধ পথ্য প্রদানসহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকেন নার্সরা।
একজন নার্স শুধু সেবা প্রদানই নয়; রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ সমন্বয় রোগী এবং তাদের পরিবারের সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যসচেতনতা শিক্ষা, উদ্বুদ্ধকরণ, চিকিৎসা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ব্যবস্থাপনা, পুনর্বাসন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে একজন ব্যবস্থাপকের দায়িত্বও পালন করে থাকেন। হাসপাতালের রোগীদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি রোগীর মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়েও পরামর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় একজন নার্সকে।
হাসপাতালে ভর্তির পর রোগীর অভ্যর্থনা, সার্বিক অবস্থা নিরীক্ষণ, জরুরি সেবা প্রদান, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে অবগতি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রদানসহ রোগী ও রোগীর এটেন্ডেন্ট বা আত্মীয়স্বজনকে সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত করার পুরো দায়িত্ব নার্সরাই পালন করে থাকেন। রোগী স্থানান্তরের সময় চিকিৎসকের মাধ্যমে রেফার্ড বা স্থানান্তর আদেশের নোট লিপিবদ্ধকরণ, রোগী ও তাদের স্বজনকে বিষয়টি যথাযথভাবে অবগতি, সংশ্লিষ্ট সব স্টাফকে বিষয়টি জানানো, রোগীকে সব রেকর্ড বা কাগজপত্র সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কার্যক্রমগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন করাও নার্সদেরই কর্তব্য। একইভাবে রোগীকে ছাড়পত্র প্রদানের সময় চিকিৎসক কর্তৃক ছাড়পত্র নোট এবং উপদেশ প্রস্তুতকরণ, রোগীর স্বজনকে চিকিৎসকের উপদেশসমূহ বুঝিয়ে দেওয়া, পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জ্ঞাত করার দায়িত্বটিও পালন করে থাকেন হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সরা।
রোগীর চিকিৎসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নার্সরা হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেন। বিশেষ করে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, পথ্য সেকশন, প্যাথলজি, ফার্মেসি, রেডিওলোজি অ্যান্ড ইমেজিং, সমাজসেবা, লন্ড্রি এবং হাউস কিপিং ইত্যাদি বিভাগের সঙ্গে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে রোগীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
রোগীর যথাযথ ও উন্নতসেবা প্রদানের নিমিত্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩। আমাদের দেশে এ অনুপাত ১:০.৭৫। বর্তমানে বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড নার্স রয়েছেন প্রায় ৭৬ হাজার; বর্তমান স্বাস্থ্য অবকাঠামো অনুযায়ী এ সংখ্যা থাকা উচিত প্রায় ৩ লাখোর্ধ্ব। অর্থাৎ নার্সিংসেবায় জনবলের ঘাটতি শতকরা ৭০ শতাংশের ওপর। রেজিস্টার্ড নার্সদের প্রায় অর্ধেক সরকারি হাসপাতাল ও সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত; এর মধ্যে প্রায় ৮৫ ভাগই শহরকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত শতকরা মাত্র ১৫ শতাংশ।
ব্রিটিশ আমল থেকেই নার্সিং পেশায় নিয়োজিতের প্রায় অধিকাংশই সমাজের অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক অংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজও শুধু সাধারণ মানুষ নয়; শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসক, হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্রের প্রয়োজনীয়তাসমূহ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার ও তুলে ধরা হয়; নার্সিংসেবা এবং নার্সদের সমস্যাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে আঁধারেই থেকে যায়। ফলে সমাজ ও মানুষের কাছে এ বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পায় না। তার ফলে সমাজের মূলধারার মানুষের নার্সিংকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মানসিকতা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। দেশে দক্ষ নার্সিং জনবলের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ব্যাপকভাবে এ পেশায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং নার্সিংসেবা প্রশিক্ষণে ও প্রশিক্ষণ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও লাভজনক মনে করছেন না এবং এ খাতকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসতে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
উপরন্তু আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র হচ্ছে; এখনো এ পেশাকে অবহেলার চোখে দেখার প্রবণতা রয়েছে। নার্সরা সমাজে সম্মান, পদমর্যাদা, গৌরব ও কাজের পরিবেশের দিক থেকে যথাস্থানে আসীনের কিছুটা ক্ষেত্রে হলেও পিছিয়ে রয়েছে। নানা কুসংস্কার, সামাজিক মনোভাব, উৎসাহ প্রদানের অভাব, প্রশংসার ঘাটতি, আর্থিক বৈষম্যসহ নানান বৈরী পরিবেশে কাজ করতে হয় তাদের। নার্সিং শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও দক্ষ প্রশিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে প্রায় সব নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নার্সদের দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি বড় অন্তরায়। শত সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশে নার্সিং খাত সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
১৯৮৩ সালে নার্সিং কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে নার্সিং সেবা, প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান খাতসমূহে উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালে নার্সদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিএসসি ইন নার্সিং চালু হয়। একই সময় নার্সিং অধিদপ্তর, সেবা মহাবিদ্যালয় এবং নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা এবং সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে অধিক পরিমাণে নার্স অন্তর্ভুক্তকরণের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১৩ সালে নার্সিং খাতের যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে সব নার্সকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণ। পাশাপাশি নার্সিংয়ের সঙ্গে মিডওয়াইফারি যোগ করে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল (বিএনএমসি) নামকরণ করা হয়। নার্সিং অধিদপ্তরকে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি (উএঘগ)-তে রূপান্তরিত করা হয়। সরকার নার্সিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ও আসন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে নার্সিং এবং মিডওয়াইফারি পদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং অধিকাংশই বাস্তবায়িত হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রধান শর্ত, নার্সিংসেবার মান উন্নয়নের জন্য এ খাতের প্রশিক্ষণের মান বাড়ানো হবে। ভালো মানের শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টিও জরুরি। রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রণেতারা, উচ্চবিত্ত ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহকে নার্সদের সামাজিক মর্যাদা, গুরুত্ব, সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, অবমূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে দূরীভূতকরণে এগিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই নয়; সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
নার্সিং একটি মহৎ পেশা, এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ পেশাকে অবহেলা বা অবমূল্যায়ন নয়, বরং নার্সিংসেবার সম্মান, মর্যাদা ও গর্বকে সমাজে তুলে ধরতে হবে। দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে নার্সিং খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা